ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ শামসুর রহমান

অভিমত ॥ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনই দেখিয়ে দেবে সমৃদ্ধির পথ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৭ আগস্ট ২০১৬

অভিমত ॥ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনই দেখিয়ে দেবে সমৃদ্ধির পথ

অবিভক্ত ভারতে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর তিনি বুঝতে পারলেন নব্য এ রাষ্ট্রটি পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক নয়। পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ মনোবৃত্তি বঙ্গবন্ধুকে সব সময় পীড়া দিত। কিন্তু মানবতাবাদী এ নেতা কখনও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন না। বরং তিনি উভয় অঞ্চলের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সর্বদা সরব। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন মানুষকে ভালবাসলে মানুষ জীবন দিয়ে হলেও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে। যখন তিনি বুঝতে পারলেন সকল আবেদন-নিবেদন সত্ত্বে¡ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মধ্য থেকে বাংলার মানুষের ভাগ্য বদল সম্ভব নয়, তখন তিনি ধীরে ধীরে মানুষকে তৈরি করেন স্বাধীনতার জন্য। এ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে কল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় চেতনা কাজ করেছে। বিশেষ করে সামরিক সন্ত্রাস, উগ্র মৌলবাদমুক্ত সাম্যের স্বদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়, যা ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। সংবিধান প্রণয়নের পূর্বে ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানের চারস্তম্ভ সম্পর্কে বিশদ বলেন, ‘আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালী জাতি- এ নিয়ে হলো বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ থাকবে। সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।... কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সেখানে গণতন্ত্র নেই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।... বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রীস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না।’ যে সাধারণ মানুষ তাঁকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সীমায় স্থান করে দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে, যে মানুষের কাছে তাঁর রাজনৈতিক হাতেখড়ি, সেই মানুষের ভাগ্য বদল করাটা ছিল রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। রাজনৈতিক কর্মবিচরণে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দ্বারে গিয়ে যে ভালবাসা, আন্তরিকতা পেয়েছেন রাষ্ট্র শাসনে এসে তিনি তা ভুলতে পারেননি। গরিবের দোয়ার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়, সে বিশ্বাস থেকে তিনি প্রতিজ্ঞ ছিলেন মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না। এ কারণে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট না হয়েও সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিলেন অবিচল। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যাদের নিচু বলে অবহেলা করা হয়, তারাই একজন রাজনৈতিক নেতার মূল শক্তি। এ শক্তিকে নেতৃত্বগুণে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসাটাই ছিল তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের লক্ষ্য। সাধারণ জনগণ তাঁর প্রতি কতটা আস্থা রাখতেন সে বিষয়ের অবতারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসেবে দিয়েছিল নির্বাচনে খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। এই শোষণহীন সমাজ, জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করতে গিয়ে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু দেখলেন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে অভ্যস্ত আমলাতন্ত্রে কোন ধরনের পরিবর্তন হয়নি। সমাজের উচ্চবিত্তের মাঝে যে শোষণ ও লুণ্ঠন চেতনা ছিল তারও কোন ছেদ পড়েনি। তাই তিনি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। উচ্চবিত্তের শোষণবৃত্তির রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টির জন্য রাজনীতি থেকে ধর্মচর্চা দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। যদিও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি তিনি ছিলেন অটুট। তিনি প্রায় বলতেন, আমি একজন বাঙালী, আমি একজন মুসলিম। মুসলমান একবার মাত্র জন্ম নেয় এবং একবারই মরে। এই বিশ্বাস ও জনাস্থার প্রতি অবিচল থেকে ঘুণে ধরা সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি বার বার হোঁচট খেয়েছেন ঘরে-বাইরের দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে। তাঁর সরল উক্তি ছিল- আমার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষ দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে প্যান্ট, টাই, স্যুট পরা সমাজের ভদ্র মানুষগুলো। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্য নায়কদের জানা ছিল রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচিয়ে রেখে সামরিক-বেসামরিক সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অপশাসন, মৌলবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। যার নির্মম পরিণতি পনেরো আগস্ট। কিন্তু ঘাতকের দল এটা বুঝতে পারেনি যে, জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবেন। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। এই শব্দগুলো বাংলাদেশকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এগুলো চেতনার, অনুপ্রেরণার, অগ্রসরের প্রতীক। এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা আত্মকেন্দ্রিকতার চর্চা বাংলাদেশকে পথভ্রষ্ট করবে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে যারা হৃদয়ে ধারণ করেন এ শব্দগুলো চর্চায় তাদের অধিকতর আন্তরিক হতে হবে। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি, হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করি, বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখি তাদের আত্মত্যাগের মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। যে জনগণের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই জনগণের মুক্তি না আসলে চেতনার চর্চা প্রহসনে রূপ নেবে। ১৬ কোটি মানুষের মুক্তি ও সমৃদ্ধির প্রকৃত আস্বাদনে আমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হোক। এই ক্ষেত্রে বড় সহায়ক বঙ্গবন্ধু আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনই দেখিয়ে দেবে সমৃদ্ধির পথ। লেখক : সাধারণ সম্পাদক (আইডিইবি) ও চেয়ারম্যান, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
×