ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা মানুষ এবং বাঙালী

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ১৭ আগস্ট ২০১৬

আমরা মানুষ এবং বাঙালী

অনেক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পথ বেয়ে চলে আসা বাংলাদেশ মোটামুটি বড়সড় সন্ত্রাসবিহীনই চলছিল। ২০১৬ সালের জুলাই ১ তারিখের রাতটা যদি না আসত, তাহলে কেমন হতো? সবকিছুকে ছাড়িয়ে এমন একটা কালরাত কোটি কোটি বাঙালীকে কাঁদিয়েছে। তার শী, অবিন্তা, ইশরাত, ফারাজ, আমাদের আত্মীয় নয়, আমাদের মতো কোটি কোটি লোকের আত্মীয় নয় ওরা। ঠিক তেমনি জাপানীজ এবং ইতালিয়ানরাও আমাদের আত্মীয় নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কোটি কোটি বাঙালী আত্মীয়সম বেদনা অনুভব করেছে। বিপথগামী আত্মঘাতী ক’জন তরুণ, তাদের সহযোগী এবং পরিকল্পনাকারী ছাড়া, আর কিছু মানসিকভাবে পর্যুদস্ত জিহাদীমনা মানুষছাড়া কেউ কি এ ঘটনায় উল্লসিত হয়েছে? আমরা যদি মনে করি, সারা বিশ্বে একটাই জাতি- তাহলো ‘মানুষ’, দ্বিতীয়ত আমরা সুনির্দিষ্ট জাতি, ‘বাঙালী’ এবং তারপর যদি ভেবে নিই আমাদের ধর্ম কি? তাহলেই সব ল্যাটা চুকে যায়। প্রতিনিয়ত যে সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে বিশ্বজুড়ে তাতে দেখি মানুষ মানুষকে মারছে, অস্বাভাবিক নয়। তারপরই দেখি এর পেছনে কোন বাঙালী জড়িত আছে কি-না? এই একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়াতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান মিলে একটাই কালচার সৃষ্টি হয়েছে তাহলো প্রধানত বাঙালী কালচার। অতিথিপরায়ণ আমাদের বাঙালী কালচারে বিশ্বাস করে, তাঁরা কি ঢাকায় ক্যাফের হত্যাকা-টি ঘটাতে পারে? সেই জন্যই কি আত্মঘাতীরা মিডল ইস্ট্রান ড্রেস পরে ছবি তুলেছিল? বাঙালী কালচারে বড় হয়ে উঠা তরুণরা এমন হত্যাকা- ঘটাতে। ওরা কি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেনি? রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়েই তো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কোটি বাঙালী মানুষের হৃদয়ে কান্নার ফলশ্রুতি কিনা জানি না, বাংলাদেশ সিকিউরিটি ফোর্সেসের দক্ষতা হঠাৎ করেই যেন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। জুলাই ১ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দা, কমান্ডো বাহিনী, আর্মির প্রোফেশন্যালিজম দেখে বলতেই হবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত। নিজের জীবনবাজি রেখে যারা জনগণের নিরাপত্তার জন্য দক্ষতা দেখাচ্ছে প্রতিদিনই, তাদের অভিনন্দন জানাই। তাদের আত্মত্যাগ নমস্য। সম্প্রতি নয় জঙ্গীদের নিশ্চিহ্ন করে একটা বিরাট সাফল্য দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি ফোর্সেস। এক্ষেত্রে কোনই সংশয় ও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এমনকি বিরোধী দলগুলোরও না। প্রটোকল অনুযায়ীই সিকিউরিটি সদস্যদের আর্মড জঙ্গীদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হয়। তা শরীরের পেছনে গুলি লাগুক, আর সামনে লাগুক। এই যে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ অহরহই গুলি করছে এবং জখম করার জন্য নয়, একবারে মেরে ফেলা নিশ্চিত করা। জখম করার জন্য শরীরের নিম্নাংশে গুলি করতে পারে। তা নয়, তাছাড়া বিচারে আজ অবদি কোন পুলিশের যাবতজীবন শাস্তি হয়নি। কেউ কনভিক্টেড হয়নি। চাকরি হয়ত চলে গেছে। কেননা ওরা আইনমাফিক কাজ করে অর্থাৎ সাসপেক্ট আর্মড থাকলে অথবা পুলিশের জীবন যদি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের গুলি করার যৌক্তিকতা ততটা স্ট্রং মনে হয় না। বাঙালী পুলিশ যেহেতু বাঙালী কালচারে বড় হওয়া, নিরীহ জনগণের হয়রানি করবে না, আশা করি। বাংলাদেশের পুলিশি আইন আমার জানা নেই। তবে একজন সন্ত্রাসীর কাছ থেকে তথ্য বের করার পর কোন কারণে মারা গেলে আমাদের আফসোস করার কি আছে? পাঁচজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর লাশ তো কেউ নিতে আসেনি। এমনকি সেই নয়জনেরও। বাংলাদেশ আকারে ছোট্ট একটি দেশ। জনসংখ্যা যদিও মাত্রাতিরিক্ত, তবু সন্ত্রাসী মুক্ত করা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, খুব কঠিন কাজ হবে না। গত দশ মাসের সিকিউরিটি ফোর্সের কাজের দক্ষতা দেখে অনেকের মনেই আশা জাগছে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও একটি অসাম্প্রদায়িক অতিথিপরায়ণ দেশ। কেননা আমরা প্রথমে মানুষ, অতঃপর বাঙালী। আমাদের মেজো মেয়ে প্রায় তিন বছর আগে আটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টার্শিপ কাজ করার জন্য বাংলাদেশ গিয়েছিল। সময়টা তখনও খুব একটা ভাল ছিল না। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সুযোগে জিহাদীমনা লোকজন আত্মপ্রকাশ শুরু করছে তখন। সেইভ দ্যা চিলড্রেনের অধীনে তিন মাস কাজ করেছিল রংপুরে। ফিরে এসে ডিগ্রী শেষ করে রাজধানী ওয়াশিংটনে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের টপ বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেলেতে পড়ুয়া তার শী জেন তেমনি একটা ইন্টার্শিপ নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল। সামার শেষে আবার বার্কেলেতে ফিরে এসে ডিগ্রী শেষ করত। মেয়েটির খাওয়াও শেষ হয়নি। মেয়েটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। অবিন্তা, ফারাজ, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র ছিল। রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে বিন্দুমাত্র দোষ করেনি যে তাদের না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমরা শুনেছি সুন্দর মুখশ্রীর জয় সর্বত্র। ঈশরাতকে মারতে এই তরুণদের একবারও হাত কাঁপেনি? বাঙালিত্ব ভুলে গিয়ে এমন অমানুষ হলো কি করে? আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের পুরো ব্লাড টেস্টে হয়ত অনেককিছু বেরিয়ে আসতে পারে। যত ভাবি ততই অবাক হই। প্রায় ৩৫ বছর ধরে ছাত্র পড়াচ্ছি। আপাত মনে হচ্ছে শিক্ষক-ছাত্র মিলে এমন হত্যাকা- ঘটাতে পারে? প্রায় দেড় হাজার বছরের ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশে প্রচলিত, এমন ঘটনা তো কখনও ঘটেনি। জনসংখ্যার ৮৫% সুন্নি ইসলাম। এক সুন্নি তরুণ অন্য সুন্নি তরুণ-তরুণীকে কোন কারণ ছাড়াই মেরে ফেলবে! বাংলাদেশের মাদ্রাসা এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষা প্রত্যক্ষভাবে দেয়া হয়, আমি বিশ্বাস করি না। তবে পরোক্ষভাবে মদদ দেয়া হয় বৈকি? নর্থ সাউথ যে ক্যান্সার নিরাময়ে এতকাল কাজ করেনি, তাতো ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই বলেছেন। বাংলাদেশ গোয়েন্দা সদস্যদের প্রশংসা না করে পারছি না। কেমন করে এক নাটের গুরু, শিক্ষক এবং দুই, কানাডা ফেরত তরুণ ফেঁসে যাচ্ছে। কোরিয়ান ভদ্রলোক যিনি ভিডিও করেছিলেন তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। এই ঢাকা রেস্তরাঁর হত্যাকা-ের দ্রুত বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি বিধান নিশ্চিত করাই বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম কাজ বলে আমি মনে করছি। এই বিচার কাজে কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল নেই যে বিচারে বাধা আসবে। তাছাড়া আমাদের নিজ দেশে আমাদেরই অতিথি- একজন নয়, দুজন নয়, ১৭টি জীবন এক নিমিষেই শেষ করা হলো। এবং আমাদেরই লোকজনই তা করেছে। এই বিচারের জন্য বিশ্ববাসী অপেক্ষায় আছে। এই বিচারের রায় প্রতিটি ভিকটিম পরিবারের কাছে পাঠাতে হবে। পরিশেষে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাটিই অনুরণন করছি, ৯/১১ এরপর যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিবর্তন এসেছে, বাংলাদেশও একটা অকল্পনীয় বিশাল একটা ধাক্কা খেয়ে চিরতরে পরিবর্তিত হয়ে গেল। লেখক : আমেরিকান প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×