ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পেটের মধ্যে ইয়াবা নিয়ে ভয়ঙ্কর চোরাচালান

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৬ আগস্ট ২০১৬

পেটের মধ্যে ইয়াবা নিয়ে ভয়ঙ্কর চোরাচালান

আজাদ সুলায়মান ॥ টানা বারো ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে ইমাম হোসেনের পাকস্থলী থেকে বের করে আনা হয় চার হাজার পিস ইয়াবা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের গলদঘর্ম প্রচেষ্টায় পাকস্থলী থেকে একের পর এক ইয়াবার পুঁটলি বের করে আনার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল চরম ঝুঁকির। তার আর্তচিৎকারে হাসপাতালে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় রবিবার রাতে। সোমবার ভোরে সর্বশেষ পুঁটলি যখন বের করে আনা হয় তখন নিস্তেজ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ইমামের দেহ। চিকিৎসদের পর্যবেক্ষণে থাকার পর আশঙ্কামুক্ত হলে দুপুরে তাকে হাসপাতাল ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়। বিকেলে তাকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কাস্টমস হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় এয়ারপোর্ট থানায়। আজ মঙ্গলবার তার রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হবে। হাসপাতাল সূত্র জানায়, রবিবার সন্ধ্যায় জরুরী বিভাগে নেয়ার পর তাকে এক্সরে করা হয়। তাতে পাকস্থলীতে সুস্পষ্ট দেখা যায় ইয়াবার পুঁটলিগুলো। পেটের এমন এক্সরে চিত্র দেখে ডাক্তাররাও আঁতকে ওঠেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইতিহাসে এমন অদ্ভুত রোগীর দেখা পাননি তারা। জরুরী বিভাগে শল্যবিদ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন অস্ত্রোপচার করার। কিন্তু তাতে ইমাম বাদ সাধেন। পেট না কেটে পায়ুপথেই এগুলো বের করা সম্ভব বলে জানান তিনি। ইমাম সে পথও বাতলে দেন। একটা সিরাপের নাম বলেন-যেটা খেলে মলত্যাগের সময় সবগুলো পুঁটলি বের হয়ে আসবে। এতে ডাক্তাররা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। একজন ডাক্তার জানতে চান- কিভাবে পেটের ভেতর একশত পুঁটলি ঢোকানো হলো। ইমাম স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দেন, ‘মুখের ভেতর পুঁটলি ভরে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে গলা পার করি।’ এমন জবাব ডাক্তারদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে। রাত আটটার দিকে এক গ্লাস পানি দিয়ে একুয়ালাক ট্যাবলেট খাওয়ানো হয় ইমামকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিস্তেজ হয়ে আসে তার দেহ। ঘণ্টা খানেক পর মলত্যাগের উপক্রম হলে তাকে একটা গামলার ওপর বসানো হয়। এতে এক কোথ দিতেই বের হয়ে আসে ইয়াবার প্রথম চালান। তাতে ছিল একশত পিস ইয়াবা। সেটা তাৎক্ষণিক তাকে দিয়েই ধৌত করিয়ে খুলানো হয়। একটি পুঁটলিতে একশত ইয়াবা দেখে ডাক্তার ও নার্সরা অবাক। প্রথম পুঁটলি বের করার পর তাকে বিশ্রামে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর আবারও তিনি নিজেই ছুটে যান ওই গামলার কাছে। সেখানে বসতেই বের হয়ে আসে আরও একটি পুঁটলি। এ্ভাবে সময় নিয়ে একটার পর একটা পুঁটলি বের করে আনতে রাত কেটে যায়্। ডাক্তার, নার্স, র‌্যাব ও শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের নির্ঘুম রাত কাটে ইমামকে ঘিরেই। ভোরের দিকে তার অবস্থা শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পেটে থাকা সর্বশেষ পুঁটলিটা কিছুতেই বের করিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ইমাম নিজেও আর বসে থাকতে পারছিলেন না। শেষ পুঁটলিটা বের করতে না পারায় ড্ক্তাাররাও উ্িদ্বগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ এ পর্যায়ে তাকে অস্ত্রোপচার করাটাও জটিল। শেষ পর্যন্ত জোর করেই তাকে আবারও বসানো হয় গামলার ওপর। কিছুক্ষণ পরেই বের হয়ে আসে সর্বশেষ চালানটি। এ সময় ইমামের শরীর নিস্তেজ। তাকে বিশেষ তত্ত্ব¡াবধানে চিকিৎসা দেয়া হয়। দুপুরের দিকে তার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে শুল্ক গোয়েন্দার হেফাজতে পাঠানো হয় শাহাজালাল বিমানবন্দরে। এখানে তার জবানবন্দী রেকর্ড করে পাঠানো হয় এয়ারপোর্ট থানায়। তাকে আজ আদালতে হাজির করা হবে। এ সম্পর্কে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, কাস্টমস অফিসে বসেই একশত পুঁটলি গণনা করা হয়। এতে ঠিক চারহাজার পিস ইয়াবাই ছিল্। ইমাম এ নিয়ে মিথ্যাচার করেননি। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছেন-তার পকেটে চার হাজার পিস ইয়াবা রয়েছে। ইয়াবার চালান কোথায় খালাস করা হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজধানীতেই একজন বড় গডফাদারের আস্তানায় গিয়ে ইমামের এ চালান পেট থেকে বের করার পরিকল্পনা ছিল। এত বড় ঝুঁকির বিনিময়ে তাকে পারিশ্রমিক দেয়ার কথা ছিল মাত্র পনেরো হাজার টাকা। আপাতত তদন্তের স্বার্থে ওই গডফাদারের নাম ঠিকানা গোপন রাখা হয়েছে। তাকে যে কোন সময় আটক করা হবে। ডক্টর মইনুল খান বলেন, এ চালান মুখ দিয়ে পেটে ভরা এবং পায়ুপথ দিয়ে বের করাটা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাসপাতালের ডাক্তার পর্যন্ত আঁতকে ওঠেন। এতগুলো পুঁটলির মধ্যে যদি একটা কোন কারণে হজম হয়ে যেত তাহলেও সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু ঘটত। আবার গলা দিয়ে পেটে ভরার সময়ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যেতে পারতেন। তবে ইমামও ধূর্ত কম নয়। তিনি জানতেন এটা বিশেষ পলিথিনের পুঁটলি। এটা সহজে হজম হবার মতো নয়। এর আগেও তিনি কক্সবাজার থেকে একই কায়দায় ইয়াবার চালান ঢাকায় এনেছেন বলে জানা যায। উল্লেখ্য, রবিবার দুপুরে পেটের ভেতর চার হাজার পিস ইয়াবা লুকিয়ে নভো এয়ারে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় আসেন ইমাম। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পাকড়াও করা হয়। পেটের ভেতরে লুকানো ইয়াবার বিশাল চালান দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যান শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। সেই চালান বের করতে গিয়ে ব্যর্থ হন বিমানবন্দরেরর চিকিৎসকরা। শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠাতে হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এক্সরে করে ডাক্তার নিশ্চিত হন- তার পেটে রয়েছে ইয়াবার চালান। ইমাম হোসেনের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে। তার পিতার নাম আব্দুল আমিন।
×