ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কম দামে ফসল বিক্রি ঠেকাতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৬ আগস্ট ২০১৬

কম দামে ফসল বিক্রি ঠেকাতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ

আনোয়ার রোজেন ॥ বগুড়া জেলার নন্দীগ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক আবদুল মালেক। আড়াই বিঘা জমি মালেকের একমাত্র সম্বল। এটুকু জমিতে তিনি প্রতিবছর আমন এবং বোরোর চাষ করেন। এ জন্য ঋণ নেন স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে। ধান মাড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে শোধ করতে হয় সে ঋণ। মৌসুমের শুরুতে দাম কম থাকে, তবুও ঋণ থেকে মুক্তি পেতে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। আবার অনটনের কারণে কোন কোন বছর মাড়াইয়ের আগেই জমির পাকা ধান চুক্তিতে বিক্রি করে দেন নামমাত্র লাভে। দেশের অধিকাংশ প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকের অবস্থা মালেকের মতো। ফসল তোলার পর পর অথবা ফসল মাঠে রেখেই তারা তা বিক্রি করে দেন চড়া সুদের মহাজনের ঋণ, দাদন কিংবা ধারদেনা পরিশোধে। ধান কিংবা অন্য ফসল উৎপাদনের পর পর বা মধ্যবর্তী সময়ে এভাবে কম দামে শস্য বিক্রি ঠেকাতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এ সময়ে কৃষকদের ঋণ দেয়া হবে স্বল্প সুদে। প্রাথমিকভাবে দেশের নয় জেলার ৫০ উপজেলার ১৫ হাজার কৃষকের মধ্যে এ ঋণ বিতরণ করা হবে। ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে প্রতিজন কৃষক ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ পাবেন। একই সঙ্গে তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হবে। শস্য উৎপাদন, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন ও অন্যান্য আয়বর্ধক কর্মকা-ের ওপর দেয়া হবে প্রশিক্ষণ। এ সম্পর্কিত একটি প্রকল্প সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ (প্রস্তাবিত) থেকে কমিয়ে সাত শতাংশ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সাফল্য এলে সারাদেশের কৃষকদের জন্য এমন কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা বরাবরই অবহেলিত জনগোষ্ঠী। আর্থিক চাপের কারণে তারা ফসলের ন্যায্য দাম পান না। এতে বেশিরভাগ সময় প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে এমন প্রকল্প নেয়া হয় খুব কম। এসব দিক বিবেচনায় সরকারের নতুন এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এ ধরনের ঋণ প্রদানে মাঠপর্যায়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। প্রকৃত অর্থে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকরা যাতে ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এটি করতে পারলে ১৫ হাজার কৃষক পরিবারের প্রায় এক লাখ মানুষের দারিদ্র্য-মুক্তির পথ সুগম হবে। সূত্র জানায়, প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের শস্য সংগ্রহ পরবর্তী সহযোগিতার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ নামের এ প্রকল্পের প্রাথমিক কার্যক্রম চলবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। সরকারী তহবিল এবং নিজস্ব অর্থায়নে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ)। প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা হবে। নির্বাচিত সুবিধাভোগীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হবে ৬০০ গ্রামভিত্তিক সংগঠন। এসব সংগঠনের মাধ্যমে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি না করে তা সংরক্ষণে কৃষককে উৎসাহিত করা হবে। মৌসুম শুরুর পর দুই থেকে তিন মাস সহযোগিতা করতে পারলেই তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পেয়ে যাবেন। পাশাপাশি তারা যাতে ফসলে মূল্য সংযোজন করতে পারেন, সে জন্য প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি সহায়তা দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু ঋণ দিয়ে কতটুকু দারিদ্র্য বিমোচন করা যাবে সেটা আসলে বিবেচনার বিষয়। এজন্য সহায়ক অন্যান্য কৌশলও নেয়া যেতে পারে। যেমন- ফসল তোলার পর সুষ্ঠু সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও ফসলের গুণগত মান রক্ষায় কার্যকর পদ্ধতি অবলম্বন করা। যাতে কৃষক তার সুবিধাজনক সময়ে তা বিক্রি করতে পারে। তবে এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার জন্য কার্ড ব্যবস্থার প্রয়োগ করা উচিত। বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষি ঋণ দেয়ার যে কার্ড আছে, তাতে কৃষকদের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ থাকে। এ কাজে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকেও যুক্ত করা যেতে পারে। যারা ঋণ সুবিধা পাবেন ॥ প্রকল্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। এসব কৃষকের অধিকাংশেরই জীবিকা শুধুমাত্র উৎপাদিত শস্যের ওপর নির্ভরশীল। তবে ‘প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকের’ কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বর্গাচাষী (যেসব কৃষক অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন এবং নিজস্ব মালিকানায় জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ এক একর বা আড়াই বিঘা), ভূমিহীন কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ দশমিক ৪৯৪ একরের কম) ও প্রান্তিক কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৪৯৪ একর থেকে ২ দশমিক ৪৭ একর)- এই তিন শ্রেণীর কৃষককে সমষ্টিগতভাবে ‘হতদরিদ্র কৃষক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, পিডিবিএফের কাজই হলো- দরিদ্রদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও ঋণের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন। প্রকৃত দরিদ্র এবং ক্ষুদ্র চাষীদের তথ্য ভা-ার পিডিবিএফের উপজেলা পর্যায়ে সংরক্ষিত আছে। তাছাড়া প্রকল্প এলাকায় আমাদের নিজস্ব সমিতি ও লোকবলও রয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগী যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারাও সহায়ক হবেন। যে সব উপজেলার কৃষক ঋণ পাবেন ॥ কৃষির উৎপাদন বেশি এমন ৯ জেলার ৫০ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের গ্রুপ বা দলে ভাগ করে ঋণ বিতরণ করা হবে। জেলাগুলো হলো- গোপালগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, নাটোর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর এবং পিরোজপুর। প্রাথমিকভাবে গ্রামভিত্তিক একেকটি দলে ২৫ জন কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ হিসাবে সবেচেয়ে বেশি ঋণ পাবেন (দুই হাজার ৭৫০ জন) দিনাজপুর জেলার ৯ উপজেলার প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক। উপজেলাগুলো হলো-বিরামপুর, বিরল, চিরিবন্দর, ফুলবাড়ি, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর, দিনাজপুর সদর, নওয়াবগঞ্জ এবং পার্বতীপুর। বগুড়া জেলার ৯ উপজেলায় ঋণ পাবেন মোট দুই হাজার ১৫০ জন কৃষক। উপজেলাগুলো হলো- আদমদীঘি, দুপচাঁচিয়া, গাবতলী, কাহালু, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, শিবগঞ্জ, সোনাতলা এবং শাজাহানপুর। পিরোজপুর জেলার সাত উপজেলার দুই হাজার ১০০ জন কৃষককে ঋণ দেয়া হবে। উপজেলাগুলো হলো- ভা-ারিয়া, কাওখালী, মঠবাড়িয়া, নাজিরপুর, পিরোজপুর সদর, নেসারাবাদ ও জিয়ানগর। ঋণ পাবেন নাটোরের ছয় উপজেলার এক হাজার ৮০০ জন কৃষক। উপজেলাগুলো হলো- বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর, নাটোর সদর ও সিংড়া। ময়মনসিংহ জেলার পাঁচ উপজেলার এক হাজার ৭২৫ জন কৃষক এই ঋণ সুবিধা পাবেন। উপজেলাগুলো হলো- ত্রিশাল, গফরগাঁও, হালুয়াঘাট, ফুলপুর ও ভালুকা। গোপালগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলায় ঋণ পাবেন এক হাজার ৫৭৫ জন। উপজেলাগুলা হলো- গোপালগঞ্জ সদর, কাশিয়ানী, কোটালীপাড়া, মকসুদপুর ও টুঙ্গীপাড়া। শেরপুর জেলার চার উপজেলায় দেড় হাজার কৃষক ঋণ পাবেন। উপজেলাগুলো হলো-ঝিনাইগাতি, নকলা, নালিতাবাড়ি এবং শেরপুর সদর। জয়পুরহাট জেলার চার উপজেলায় ঋণ পাবেন ১১শ’ কৃষক। উপজেলাগুলো হলো- আক্কেলপুর, কালাই, ঘাটাল ও পাঁচবিবি। প্রকল্পের আওতায় ঋণ পাবেন গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তিন শ’ জন প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষক।
×