ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত-দুই ছাত্রকে বাঁচিয়ে নিজে প্রাণ দিলেন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৬ আগস্ট ২০১৬

মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত-দুই ছাত্রকে বাঁচিয়ে নিজে প্রাণ দিলেন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মানবতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পিকআপ চালক পঁচিশ বছর বয়সী যুবক মোহাম্মদ সারোয়ার। তাও আবার খোদ রাজধানীতেই। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে খালের পানির তীব্র স্রোতে ডুবে যাওয়া দুই ছাত্রকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বাঁচিয়ে আনার পর ফুটবল আনতে গিয়ে খালের পানির তীব্র স্রোতে তলিয়ে গেলে মৃত্যু হয় সেই মহামানবের। ব্যস্ত ঢাকায় সচরাচর এমন মহামানবের দেখা মেলে না। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর সেই মহামানবের নিথর দেহ পানি থেকে তুলে আনেন। তোলার পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী ও উপস্থিত সদস্যরাও কেঁদেছেন। বলেছেন, সত্যিই মহাপুরুষ। লাশ তোলার পর শুধু একনজর অতি মহানুভব সেই মানুষটিকে দেখার জন্য সেখানে শত শত মানুষ ভিড় করেন। সবার চোখেই কান্না। সবাই বলছিলেন, সত্যিই মহামানব। কিন্তু যাদের বাঁচিয়ে এবং যাদের ফুটবল আনতে গিয়ে যে মহামানবের মৃত্যু হলো, তার পরিবারের কি হবে? তার পরিবারের প্রতি মহানুভবতা দেখাবে কে বা কারা? এদিকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া দুই ছাত্রের পরিবারে একইসঙ্গে নেমে এসেছে আনন্দ আর বিষাদের ছায়া। দুই ছাত্র বেঁচে যাওয়ায় তাদের পরিবারের সদস্যরা মহাখুশী। কিন্তু যে সারোয়ার তাদের বাঁচিয়েছেন, সেই সারোয়ারের মৃত্যু তারা মেনে নিতে পারছেন না। সবার মুখেই একই কথা। হায়! এ কি হলো! কেন সারোয়ার ফুটবল আনতে গেল। কে তাকে ফুটবল আনতে বলল? সোমবার দুপুর বারোটার দিকে রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন বেরাইদ একশ ফুট রাস্তার খালপাড়ের তিন নম্বর ব্রিজের নিচে ঘটে স্মরণকালের মর্মস্পর্শী এমন ঘটনা। স্থানীয়রা ও পুলিশ জানিয়েছে, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বন্ধ থাকায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় ছাত্র বাড্ডা থানাধীন বেরাইদ পাঁচতলা এলাকার একশ’ ফুট রাস্তার পাশে খালপাড়ে তিন নম্বর ব্রিজের কাছে ফুটবল খেলছিল। তখন দুপুর বারোটার মতো বাজে। খেলার এক পর্যায়ে ফুটবলটি খালের পানিতে পড়ে যায়। এ সময় ছাত্ররা খালের অল্প পানিতে নেমেই ফুটবল খেলছিল। খালের পাড়ে নিহত সারোয়ার ও তার সমবয়সী চার বন্ধু পিকআপ খালের পানি দিয়েই পরিষ্কার করছিল। ছাত্ররা ফুটবল খেলছিল, আর সারোয়ারসহ অন্য চারজন পিকআপ পরিষ্কারে ব্যস্ত ছিল। খেলার সময় ফুটবলটি সামান্য ভাটির দিকে স্রোতের মধ্যে চলে যায়। এ সময় এক ছাত্র ফুটবলটি আনতে গিয়ে ডুবে যায়। ওই ছাত্র বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দিচ্ছিল। এ সময় তাকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক ছাত্র সেখানে যায়। সেও স্রোতের মধ্যে পড়ে যায়। তারা দু’জনই ডুবে যাচ্ছিল। বিষয়টি দেখতে পেয়ে সারোয়ার দ্রুত ছাত্রদের বাঁচাতে স্রোতের মধ্যে নেমে যায়। প্রথমে এক ছাত্রকে তুলে খালের পাড়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে যায়। দ্বিতীয় দফায় অন্যজনকে ডুবন্ত অবস্থা থেকে তুলে তাকেও খালের পাড়ের নিরাপদ জায়গায় রাখে। ততক্ষণে ফুটবলটি আরও খানিকটা ভাটির দিকে তীব্র স্রোতের মধ্যে চলে যায়। এ সময় মহানুভব সারোয়ার ছাত্ররা যাতে ফুটবল খেলার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয় এজন্য ফুটবলটি এনে দিতে প্রচ- স্রোতের মধ্যে সাঁতরে যায়। যেতে যেতেই ফুটবলটি আরও তীব্র স্রোতের মধ্যে যায়। সারোয়ার সেই স্রোতের মধ্যে যাওয়া মাত্র পানির তীব্র ঘূর্ণায়মান স্রোতের মধ্যে তলিয়ে যায়। অনেকক্ষণ হয় সারোয়ারের কোন হদিস নেই। এ সময় সারোয়ারের বন্ধু ও ফুটবল খেলারত ছাত্ররা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে খোঁজাখুঁজি চলে। কিন্তু সারোয়ারের হদিস নেই। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সেখানে হাজির হন। ফায়ার সার্ভিসের বারিধারা স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা সেলিম রেজা জানান, বেলা পৌনে একটার দিকে তারা খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন। চারটি ইউনিট সেখানে কাজ করে। ৬ জন ডুবুরি সারোয়ারের সন্ধান চালায়। শেষ পর্যন্ত বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সারোয়ারের লাশ উদ্ধার হয়। লাশটি ডুবন্ত অবস্থায় তিন নম্বর ব্রিজ থেকে অন্তত চারশ ফুট ভাটির দিকে পানির তলদেশ কাদার সঙ্গে ডুবে ছিল। সারোয়ারের লাশ খালের পাড়ে তোলার পরে শত শত মানুষ ভিড় জমায়। শুধুমাত্র মহানুভব সারোয়ারকে একনজর দেখার জন্য। যখন সারোয়ারের লাশ খালের পাড়ে রাখা হয়, উপস্থিত মানুষ আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন অনেকেই। বলছিলেন, সত্যিই মহাপুরুষ, মহানুভব, সত্যিকারের মানবপ্রেমিক। আরও কত নামে যে তাকে ডাকা হচ্ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। সেখানে আবাল বৃদ্ধ বণিতা থেকে শুরু করে সমাজের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ভিড় করেছিলেন। শুধুই একনজর সারোয়ারকে দেখার জন্য। শত শত মানুষের চোখের জলে আর গগণ বিদারী আর্তনাদে তখন বেরাইদ খালপাড়ের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল থেমে যায়। সবার মুখেই সারোয়ারের কথা। উপস্থিত জনতা বলছিলেন, যে মহাপুরুষ নিজের জীবন দিয়ে, অন্যের জীবন বাঁচিয়েছে। অন্যের পরিবার বাঁচিয়েছে। সেই নিহত সারোয়ারের পরিবারের কি হবে? তার পরিবারের প্রতি মহানুভবতা কি কেউ দেখাবে? বাড্ডা থানার ওসি এমএ জলিল জানান, সারোয়ারের পিতার নাম মৃত আতাহার মৃধা। বাড়ি বরগুনা জেলা সদরের বড় গলাচিপা গ্রামে। সারোয়ারের তিন ভাই ও এক বোন রয়েছে। বড়বোন বিবাহিত। স্বামীর সঙ্গে বাড্ডার নতুনবাজার এলাকায় বসবাস করে। সেই বোনের বাড়িতেই থাকত সারোয়ার। ব্যক্তি জীবনের সারোয়ারের সুনির্দিষ্ট কোন পেশা ছিল না। সে পিকআপ চালাতে জানত। সারোয়ার বড়বোনের বাসায় থাকার পাশাপাশি তাদের পরিচিত একজনের বাড়িতে বড়ও হয়েছে। সেই বাড়ির মালিক পিকআপের ব্যবসা করেন। ছুটির দিনে খালের পাড়ে সেই পিকআপ নিয়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার করছিল। সারোয়ারের সঙ্গে আরও চারজনও তাদের পিকআপ পরিষ্কার করছিল। সারোয়ার একেক সময় একেক কাজ করত। কখনও পিকআপ চালাত। আবার কখনও দোকানে কাজ করত। সারোয়ার গুলশানের একটি দোকানের কর্মচারী ছিল। সারোয়ার অবিবাহিত ছিলেন।
×