ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লক্ষ্য- পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন;###;খুলে যাবে রফতানির নতুন দিগন্ত ;###;সুদিন ফেরাতে পাট আইন করার পাশাপাশি পাটনীতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার

তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৬ আগস্ট ২০১৬

তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন

তপন বিশ্বাস ॥ পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে চীন। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে পাটের বস্ত্র, বিভিন্ন প্রকার সুতা তৈরি করা হবে। এই সব বস্ত্র দিয়ে তৈরি সামগ্রী বিদেশে রফতানির এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। এটি বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে পাট ও বস্ত্র সচিব এম এ কাদের সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, পাট সেক্টর আধুনিকায়ন সম্পন্ন হলে রফতানির মাধ্যমে এই খাত থেকে বছরে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার আহরণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি পাটের সুদিন ফেরাতে পাট আইন করার পাশাপাশি পাটনীতি সংশোধন করারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, লোকসান থেকে মুনাফায় ফেরাতে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে সরকারী পাটকলগুলো। প্রাথমিকভাবে তিনটি পাটকল আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন পাটনীতি করছে সরকার। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করলেই হবে না। অতিরিক্ত শ্রমিক কমাতে হবে। পাটের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। পাটকলগুলোকে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে যেতে হবে। তাহলেই পাটের দেশী-বিদেশী বাজার কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, টানা ২২ বছর লোকসানের পর গত ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারী পাটকল পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) কিছুটা লাভের মুখ দেখলেও লোকসান যেন পিছু ছাড়ছে না। ফলে সোনালী আঁশ পুনর্জাগরণের যে স্বপ্ন দেখেছিল কৃষকসহ এ খাত সংশ্লিষ্টরা তা যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে চলতি বছর ছয়টি পণ্যে পাটের মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন হওয়ায় কিছুটা হলেও এ খাত সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে সরকার বন্ধ পাটকল চালু করতে নজর দিলেও তা সংস্কার ও আধুনিকায়নে গুরুত্ব দেয়নি। ৬০ থেকে ৭০ বছরের পুরনো যন্ত্রাংশ দিয়ে চলছে পাটকলগুলো। এসব পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। এছাড়া মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে বিজেএমসি’র ২৩ পাটকলে দৈনিক ৬৮০ টন পাটপণ্য উৎপাদিত হয়। অথচ মিলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হলে উৎপাদন বাড়বে কয়েক গুণ। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামের আমিন জুটমিল, ঢাকার করিম জুটমিল ও খুলনার প্লাটিনাম জুটমিল আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ২ বছরের মধ্যে এই তিনটি পাটকল আধুনিকায়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি চীন সরকারের মালিকানাধীন ‘চায়না টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন ফর ফরেন ইকোনমিক এ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে বিজেএমসি। এদিকে পাটের সুদিন ফেরাতে পাট আইন করার পাশাপাশি পাটনীতি সংশোধন করারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রস্তাবিত নতুন পাটনীতিতে পাটপণ্য বহুমুখীকরণ, এ খাতের উন্নয়নে সরকারী প্রণোদনা প্রদান, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা ও পাটকলের আধুনিকায়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট সচিব বলেন, পাট ও পাটপণ্যকে সুরক্ষা দিতে নতুন আইন ও নীতি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মিলগুলো আধুনিকায়ন করা গেলে সেখানে পাটের শাড়ি, সোফা, কভার ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা সম্ভব হবে এবং তা বিদেশে রফতানি করে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এ কারণে মিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে আধুনিকায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিজেএমসির ২৬ মিলের মধ্যে তেইটি আধুনিকায়ন করা হবে। তবে প্রথম পর্যায়ে তিনটি মিলকে আধুনিকায়নের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। মিল তিনটির আধুনিকায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীনের সঙ্গে জি টু জি’র আওতায় মিলগুলোর আধুনিকায়ন করা হবে। এতে মিল তিনটি থেকে বছরে দুই লাখ ৭৫ হাজার ৫শ’ টন পাটপণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। এই মিল থেকে উৎপাদিত পণ্য থেকে চীনে রফতানি করা হবে। চীনের চাহিদার বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হলে তা অন্য দেশে রফতানি করবে সরকার। সচিব বলেন, পাটের বহুমুখী পণ্যের উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। এই কাঁচামালের জন্য অন্য কোন দেশের ওপর নির্ভর করতে হয় না। আধুনিকায়ন হলে এই সেক্টর থেকে বছরে প্রায় ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আহরণ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এই সরকার আর এক টার্ম ক্ষমতায় এলে এই সেক্টরে আয় তৈরি পোশাক শিল্পকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমাদের গার্মেন্টস সেক্টর ধ্বংস করতে নানাবিধ ষড়যন্ত্র রয়েছে। কোন কারণে এই সেক্টরের কাঁচামাল পাওয়া না গেলে বা কোন দেশ সুতা রফতানি করতে অনীহা প্রকাশ করলে এই সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। কিন্তু পাট সেক্টর এগিয়ে গেলে তাতে আর কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। কাঁচামালের ওপর কারও নির্ভর করতে হবে না। পাশাপাশি সরকার নিজস্ব অর্থায়নে তিনটি পাটকল আধুনিকায়ন করতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে থাকা এসব পাটকলের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ এবং সংস্কার করতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এক বৈঠকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট সচিব বলেন, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে তিনটি পাটকলকে আধুনিকায় করতে যাচ্ছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় দুই শ’ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে বিজেএমসির অধীন ২৬ পাটকল চালু রয়েছে। এসব পাটকলে কাজ করছেন প্রায় ৮২ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো এসব মিলে শ্রমিক থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতা নেই। তাছাড়া পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদনের কারণে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট সচিব বলেন, পাটকলগুলো আধুনিকায়ন করা হলে উৎপাদন খরচ ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ করে আসবে। এতে জনবল কম প্রয়োজন হবে। তবে আমরা কোন জনবল ছাঁটাই করব না। নতুন করে কোন জনবল নিয়োগ দেয়া হবে না। এতে প্রতিবছর জনবল কমতে থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে বছরে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকার আর এই সেক্টরে ভর্তুকি দিতে চায় না। এই লোকসান কাটিয়ে এ সেক্টরকে লাভজনক এবং বাংলাদেশে শীর্ষ লাভজনক এটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই। সূত্র জানায়, সরকারী পাটকলগুলো সংস্কারের বিষয়ে পাট মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে পাটকলগুলোর বর্তমান অবকাঠামোর সংস্কার, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, যন্ত্রপাতি সংস্কার ও প্রতিস্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হবে। আর চলতি বছর থেকে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে এবং তা শেষ হবে আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে। পাট মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচ ধাপে সব পাটকলের বিএমআরই সম্পন্ন হবে। প্রথম ধাপে তিনটি এবং ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর পাঁচটি করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের বিএমআরই করা হবে। ২০২০ সালে পঞ্চম ধাপে ছয়টি পাটকলের বিএমআরইর মাধ্যমে পুরো সরকারী পাটকলের আধুনিকায়ন শেষ করা হবে।
×