ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাসনাতের স্বীকারোক্তি-তিনি হিযবুতের সক্রিয় সদস্য

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ আগস্ট ২০১৬

হাসনাতের স্বীকারোক্তি-তিনি হিযবুতের সক্রিয় সদস্য

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজা করিম স্বীকার করেছেন, হামলাকারী জঙ্গীদের উইকার ও থ্রিমা নামে দুটি এ্যাপস ডাউনলোড করে দিয়েছে। তার মোবাইল ফোনে জঙ্গীদের ডাউনলোড করে দেয়া এ্যাপস দুটি পেয়েছে তদন্তকারীরা। হাসনাত রেজা করিমকে জঙ্গীদের কাজে তাকে সহায়তা করেছে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খান। দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে এনে হাসনাত রেজা করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীরের একজন সক্রিয় সদস্য তাও স্বীকার করেছেন। আর এ কাজে বিভিন্ন সময় হাসনাতকে সাহায্য করে তাহমিদ হাসিব খান। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দিন জঙ্গীরা তাদের নিজস্ব যোগাযোগের জন্য ডাবুআইসিকেআর নামে এ্যাপস ব্যবহার করেছে জঙ্গীরা, যা হাসনাত করিমের মোবাইলে ওই এ্যাপসটি পাওয়া গেছে। এ এ্যাপস পাওয়ার পর জঙ্গীদের ডাউনলোড করে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন হাসনাত করিম। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে রাত ৮টা ৪৪ মিনিটে হলি আর্টিজানে ঢুকে জঙ্গীরা। এরপর রাত ৮টা ৫৭ মিনিটে তার মোবাইলে ওই এ্যাপসটি ডাউনলোড করেন তিনি। ফোনসেট থেকে তিনি ‘উইকার ও থ্রিমা’ নামক মোবাইল এ্যাপস ডাউনলোড করে দেন জঙ্গীদের। আর এই এ্যাপসের মাধ্যমে জঙ্গীরা বিদেশীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ছবি ও ভিডিওচিত্র মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি উগ্রপন্থী সংগঠনের মুখপত্র ‘আমাক’ নিউজ এজেন্সির কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ওইসব ছবি ও ভিডিও চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্সের স্বত্বাধিকারী রিটা কাৎসের কাছে। হলি আর্টিজান বেকারির ভেতর ও বাইরে থাকা কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও জঙ্গীদের ধারণ করা মোবাইলের ভিডিও পরীক্ষা করে তদন্তকারীরা দেখতে পান, ইতালিয়ান নাগরিক ক্লদিয়া মারিয়া দান্তানাকে খুন করে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেট ও জীবিত শ্রীলঙ্কার নাগরিক প্যাপথা সায়মার স্মার্টফোন সেটটি নিয়ে নেয় জঙ্গীরা। এরপর এ দুটি ফোনসেট হাসনাত করিমের হাতে দেয় এবং তারপর জঙ্গীদের কী যেন বলতে দেখা যায়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর একজন কোরিয়ান নাগরিক গোপনে ভিডিও ধারণ করেছেন। এটা তদন্তাকারীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন। এতে দেখা যায়, কিলিং মিশন শেষে হাসনাত করিম ও তাহমিদকে জঙ্গী নিবরাস ইসলামের সঙ্গে অস্ত্র হাতে রেস্তরাঁটির ছাদে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায় কথা বলছে। হাসনাত করিম যেমন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তেমনি নিহত জঙ্গী নিবরাস ইসলামও একই বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই দুজনকে জঙ্গী হামলার সময়ে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিমায় কথা বলতে দেখা যাওয়ার ঘটনায় প্রমাণ দেয় তারা পূর্বপরিচিত, যা এ বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হলি আর্টিজান বেকারির ভেতর ও বাইরে থাকা কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ও জঙ্গীদের ধারণ করা মোবাইলের ভিডিও থেকে দেখা যায়, তিনিও জঙ্গীদের সঙ্গে কী যেন কথা বলছেন। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, রাত থেকে ভোর পর্যন্ত হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি থাকাবস্থায় মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করেছেন হাসনাত করিম। এই সিসিটিভিতে ফুটেজ দেখানো হয়েছে তাকে। তখনই হাসনাত করিম স্বীকার করেন, তার ডাউনলোড করে দেয়া এ্যাপস ব্যবহার করে সাইট ইন্টিলিজেন্সসহ বিভিন্ন স্থানে ছবি ও ভিডিও চিত্র পাঠিয়েছে জঙ্গীরা। এতবড় হত্যাকা-ের মধ্যে তাকে সপরিবারে জীবিত রাখা এবং পুরো সময় তাকে কেন স্বাভাবিক দেখা গেছে। হলি আর্টিজান বেকারির হাসনাত করিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে দেখা গেছে, তাহমিদ হাসিব খানকেও, যিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরেন্টোর শিক্ষার্থী। এমনকি একপর্যায়ে হাসনাত করিম, তাহমিদ খান ও নিহত জঙ্গী নিবরাসকে একসঙ্গে হোটেলটির ছাদে দেখা যায়। সেখানে তাহমিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা গেছে সিসিটিভির ফুটেজে। কথা বলার সময় তাদের প্রত্যেককে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। সিসিটিভি ফুটেজে এমন দৃশ্য দেখার পর জঙ্গী হামলার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেন হাসনাত করিম। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, গুলশান আড়ংয়ের সামনের রাস্তা থেকে গ্রেফতার করা হয় হাসনাত করিমকে ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় তাহমিদকে। প্রথম দফায় তাদের আট দিন করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় হাসনাত করিমের জঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টির তথ্য প্রমাণ পাওয়ার গুলশানের জঙ্গী হামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আবারও আট দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাহমিদ হাসিব খানকেও আবার ছয় দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাহমিদ হাসিব খান আফতাব বহুমুখী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রহিম খান শাহরিয়ারের ছেলে। তিনি কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং কানাডার স্থায়ী নাগরিক। হাসনাত করিমের বাবা মোহাম্মদ রেজাউল করিম। হাসনাত বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিক। ব্রিটেনের নাগরিক হলেও সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে এসে বাবার আর্কিটেক্ট ফার্মে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই গুলশানে স্প্যানিশ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে জঙ্গীরা। এতে ২০ জিম্মি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। এছাড়া পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এ নিহত হয় ৬ জঙ্গী। তারা হচ্ছে নিবরাস ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্ব¡ল, মীর সামিহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও শরীয়তপুরের সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। এছাড়া সন্দেহভাজন জঙ্গী জাকির হোসেন শাওন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই হাসপাতালে মারা যায়।
×