ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কামালউদ্দীন আহমদ

বঙ্গবন্ধুর তুলনা তিনি নিজেই

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৬ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর তুলনা তিনি নিজেই

স্বাধীনতার ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। এই ইতিহাসের নির্মাতা জনগণ। আর সেই সঙ্গে সঠিক নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। দেশের জনমতকে তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। দেশের জনমতকে সঙ্গে পেয়েছিলেন বলেই দেশের মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিলেন অভীষ্ট লক্ষ্যে; স্বাধীনতার সিংহ দরজায় আর তা ছিল আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার অভিপ্রায়। এই অভিপ্রায়ে বাদ সাধল কিছু পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা-মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘটাল পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকা-। লজ্জায় অধোবদন হলো গোটা জাতি। সুশিক্ষিত জাতি আমরা নই বলেই এই ঘটনা ঘটে যেতে পারল, স্বাধীনতার স্বল্পকাল পরেই। এই শিক্ষিত সমাজের কাছেই বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে বলেছিলেন “আমরা শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। শিক্ষিতের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে, দুর্নীতির কথা বললাম তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে চালান দেয় কারা? হোর্ড করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে। আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই ৫ জনের মধ্যে, এর বাইরে নয়।” বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ কতটা সত্য তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অবলোকন করলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেই তো মোশতাক-জিয়া ক্ষমতা নিয়েছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন, জেনারেল মইনুদ্দীন ও ফখরুদ্দীন একই কথা বলে ১/১১-তে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তখন আমরা দেখেছি ঠিকানাবিহীন কোটি টাকার গাড়ি রাস্তায় পরিত্যক্তভাবে পড়ে থাকতে, বালিশের নিচ থেকে লাখ লাখ টাকা বের হতে। এই সমস্ত নির্লজ্জ কর্মকা-ে বঙ্গবন্ধুর কথায় ওই ৫ জন শিক্ষিত লোকই জড়িত ছিল। ওই হাওয়া ভবনে এই চরিত্রহীন শিক্ষিত লোকেরই আনাগোনা ছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি উক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। “আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, শিক্ষিত ভাইয়েরা, আপনাদের লেখাপড়ার যে খরচ জনগণ দিয়েছে, তা শুধু আপনাদের সংসার দেখবার জন্য নয়। আপনাদের ছেলে-মেয়েদের দেখবার জন্য নয়। দিয়েছে এই জন্য যে, তাদের জন্য আপনারা কাজ করবেন। তাদের সেবা করবেন। তাদের আপনারা কি দিয়েছেন? কি ফেরত দিয়েছেন? কতটুকু দিচ্ছেন? তাদের টাকায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, তাদের টাকায় ডাক্তার সাহেব, তাদের টাকায় অফিসার সাহেব, তাদের টাকায় রাজনীতি সাহেব, তাদের টাকায় মেম্বার সাহেব, তাদের টাকায় সব সাহেব। আপনারা দিচ্ছেন কি? কি ফেরত দিচ্ছেন? আত্মসমালোচনা করুন। বক্তৃতা করে লাভ নেই। রাতের অন্ধকারে খবরের কাগজের কাগজ ব্ল্যাক মার্কেটিং করে সকালবেলা বড় বড় কথা লেখার দাম নাই। রাতেরবেলায় ওষুধ ব্ল্যাক মার্কেটিং করে বড় বড় কথা বলার দাম নাই। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মদ খেয়ে অনেস্টির কথা বলার দাম নাই। তাহলেই হবেন মানুষ।” এমন মানুষই বঙ্গবন্ধু খুঁজেছিলেন। পেয়েছিলেন কি? কিংবা এখনও এই মানুষ কি আমরা হতে পেরেছি? এই মানুষ হতে পারিনি বলেই বার বার আমরা হোঁচট খাচ্ছি। হিংসা, পরনিন্দা, বিত্তলোভ, অহংকার, দেশপ্রেমহীনতা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। গরিব আরও গরিব হয়েছে, বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছে। শহরের সঙ্গে গ্রামের পার্থক্য আরও বেড়েছে। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে মানুষ প্রাণভরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে রায় দিয়েছে দেশ পরিচালনার জন্য। আশা যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো আবার রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ফিরে আসবে। বেকারত্ব হ্রাস পাবে। যুবকদের কর্মসংস্থান হবে। মনে রাখতে হবে এই যুবকদেরই একটা বড় অংশ ওই দুটি নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল মুক্তিযুদ্ধপক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে। কি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু এই যুবকদের নিয়ে। কি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু এই যুবকদের নিয়ে যাদের একটি বড় অংশ গ্রামে বাস করে। তিনি বলেছিলেন, “আমার যুবক ভাইয়েরা, যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে, এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে যেয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করতে হবে। এ কাজে যুবক চাই, ছাত্র চাই, সকলকে চাই।” চিন্তাটা তো মহৎই ছিল। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তবা এই যুবক শ্রেণীর এই অধঃপতন হতো না। এত মাদকাসক্ত, হতাশ, বেকার যুবককে এভাবে নির্বাচনী খেলায় মাতামাতি করতে হতো না। টেন্ডারবাজি করতে হতো না। মহান নেতাকে স্মরণ করতে গিয়ে চিহ্নিত করতে হবে নিজেদের ব্যর্থতা। ব্যর্থতার এই গ্লানি অনেকাংশে পূরণ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি কার্যকর করার মাধ্যমে। আমরা কেউ-ই পারিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারকেই তা করতে হলো। বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার সকল ব্যবস্থাই ’৭৫-এর পরবর্তী মৌলবাদ পরিবেষ্টিত সরকারগুলো প্রয়োগ করেছে। এখনও যে এই কলার চর্চা হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির দায়িত্ব অনেক বড়। এই দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ্য কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। তাদের থাকতে হবে বিনয়, সততা এবং নিজ স্বার্থ বিসর্জনের ক্ষমতা। সরকারী দল হিসেবে তো দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনে ব্রতী হতে হবে তাদের। রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণকে বুঝতে দিতে হবে তাদের কল্যাণ সাধনে নিবেদিত কার্যক্রমকে। দেশের সমস্ত গ্রামকে শক্তির উৎস মনে করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। শহর ও গ্রামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। উন্নয়ন মানে শুধু শহরের উন্নতি নয়, ব্যয়বহুল প্রশাসন নয়; স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ের সংস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। কোন পর্যায়ে আমলার ক্ষমতায়নের প্রয়োজন নেই। সর্বস্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত রাখতে হবে। দুর্নীতি বা অযোগ্যতার কারণে পরবর্তী নির্বাচনে তারা স্বাভাবিকভাবেই অপসৃত হবে। বঙ্গবন্ধু জনগণকেই ক্ষমতাবান রাখতে চেয়েছিলেন। আর তাঁর আদর্শ স্মরণে রেখে সব পরিকল্পনা প্রণীত হওয়া আবশ্যক। আমাদের সংস্কৃতি যে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি তা যেমন একবার ১৯৫২ সালে তেমনি ১৯৭১ সালে দ্বিতীয়বার সত্য প্রমাণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। এই সংস্কৃতি হচ্ছে বাঙালিত্ব। বাঙালীমানসের পরিপুষ্ট তাই স্বাধীন বাঙালীর প্রধান লক্ষ্য হওয়া চাই। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়সংকল্পকে করতে হবে পাথেয়। তাঁর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নই তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁর আদর্শ হচ্ছে জনগণের কল্যাণসাধন। তিনি দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন স্বনির্ভর করে। বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে নয়। তাই তো তিনি নিজে প্রগতির তৈরি ভস্কল ভিভাতে চড়ে অফিসে গিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে পর্যন্ত এই গাড়ি উপহারস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। আজ যদি সত্যিই দেশের উন্নতির কথা আমরা ভাবি, তাহলে ফাঁকা কথার আওয়াজ না তুলে এমন একটা কর্মসূচীই তুলে ধরা উচিত, যাতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত দেশবাসীর মধ্যকার অতলস্পর্শ বিচ্ছেদ দূর করার কার্যক্রম থাকবে এবং তা করতে গেলে শিক্ষিত লোকদের অসার হাত দুটো যাতে কর্মক্ষম হয় এবং অশিক্ষিত লোকদের চিত্তবৃত্তি যাতে বিকশিত হয়ে ওঠে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা এইদিকে চোখ রেখে ঢেলে সাজাতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষাটা হবে সমস্ত দেশের কাজে লাগানোর জন্যÑ মুষ্ঠিমেয় ভদ্রশ্রেণীর টাকার অংক কাঁপিয়ে তোলার জন্য নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর জনকল্যাণ কর্মসূচী সন্দেহাতীতরূপে জনগণের মনে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন। নতুন উদ্দীপনায় গোটা জাতি কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছিল। নিজেকে তিনি সাধারণের একজন ভাবতেন। আমরা ক’জন শিক্ষিত লোক সাধারণের মতো ভাবি?’ ভাবি না, ভাবা সম্ভবও নয়। তাই তো তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। লেখক : চেয়ারম্যান, ইংরেজী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×