ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কামাল লোহানী

বিএনপি এবার কী ‘কারিশমা’ দেখাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৬ আগস্ট ২০১৬

বিএনপি এবার কী ‘কারিশমা’ দেখাবে?

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, নামটা বাংলা হলেও পরিচয় ‘বিএনপি’ নামে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি সংক্ষিপ্তকরণে বিএনপি হয়েছে এবং এই ইংরেজীটাই ব্যবহার করতে ভালবাসেন সকলে। এই বিএনপির বীজ ‘জাগদল’ বলেই বোনা হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান যেহেতু সেনাপ্রধান ছিলেন, সেখান থেকে ক্ষমতা দখল করে হলেন রাষ্ট্রপ্রধান তখন তার ক্ষমতালিপ্সা মেটাবার উদ্দেশ্যেই এই জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত চিকিৎসক থেকে বেকার রাজনৈতিক নেতা বিশেষ করে আওয়ামীবিরোধী এবং মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, ভাসানী ন্যাপ ইত্যাদি দলের উচ্ছিষ্টদের নিয়ে জাগদল গড়লেন। সেটাই বিএনপি হলো, পুরোপুরি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ক্ষমতাসীন জিয়ার সেনাসহযোগীদের বদৌলতে। ’৮১ সালে জেনারেল জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি, তখন মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধাদের হাতেই নিহত হলেন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। সৎ-যোগ্য মুক্তিযোদ্ধারা সকলে তার কার্যক্রমকে সমর্থন করতে পারেনি বলেই এই ‘অঘটন’ ঘটল। জেনারেল এরশাদ তখন সেনাধ্যক্ষ। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন নির্বাচনের মাধ্যমে কিন্তু তার মন্ত্রিসভাকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ অভিযুক্ত করে জেনারেল এরশাদ তাকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করলেন। এটাই তার লক্ষ্য ছিল বলে এরশাদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার সহযাত্রী হবার কথা থাকলেও ব্যক্তিগত সমস্যার অজুহাতে চট্টগ্রাম যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। জিয়াকে হত্যার পরও সেনাধ্যক্ষ হিসেবে কোন সেনানিবাসকে মুভমেন্টের নির্দেশও দেননি। সামরিক শাসক হয়ে এরশাদ একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসলেন, বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রের দায়িত্ব হারালেও দলপ্রধান ছিলেন। কিন্তু জিয়াস্ত্রী কুচক্রী মহলের পরামর্শে ক্ষমতা হাতে পাবার প্রাথমিক দ্বন্দ্বে জয়যুক্ত হতে বিচারপতি সাত্তারকে দলীয় প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে খালেদা জিয়া নিজেই সেই অবস্থানটি দখল করে নিলেন। সেই থেকে ক্ষমতার লিপ্সা তাকে পেয়ে বসে এবং বশংবদরাও জিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনীতি করার কৌশল খুঁজে বের করে জিয়ার স্ত্রীকেই দলীয় প্রধান সাজিয়ে নেন। তখন থেকে ‘লাজ নম্র’ গৃহবধূ খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সবক নেন স্বার্থবাদী রাজনীতিক চক্রের পরামর্শে। যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানীদের কাছে বেশ স্বচ্ছন্দেই দিন কাটাচ্ছিলেন, এমনকি স্বামী মেজর জিয়ার নির্দেশ পর্যন্ত উপেক্ষা করতে সাহসী হয়েছিলেন, সেই ভদ্র মহিলা মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আপন পরিচয় ফিরে পেতে স্বামীকেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, তখন বৈরী মানসিকতায় ক্রুদ্ধ মেজর জিয়াকে ডেকে এনে ঐ খালেদা জিয়াকে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন যেভাবে, আজ ‘বিশাল নেত্রী’ একবার ভেবে দেখুন, অন্তত নিভৃতে কি জনান্তিকে বঙ্গবন্ধুর মমতা-করুণা না পেলে খালেদা তাহলে আজ কোথায় থাকতেন? কালের বিবর্তনে সেই রোরুদ্যমান খালেদা জিয়া তার সেদিনের অসহায়ত্বের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন এবং ত্রাণকর্তা পিতৃতুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই খালেদা জিয়া সবচেয়ে বেশি অবমাননা করছেন নানা কৌশলে নানা ফন্দি-ফিকির এঁটে। তার কি একবারও চিন্তা হয় না যিনি দেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তার স্বামী যাঁর নেতৃত্বে তাঁরই নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন স্বাধীন বাংলা (বিপ্লবী) বেতার কেন্দ্রের সূচনাগৃহ কালুরঘাট থেকে, সেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘অস্বীকার ও অবমাননা’ করে চলেছেন চেলাচামু-াদের পরামর্শে সঙ্কীর্ণ স্বার্থবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কেবলই ক্ষমতা দখল করার জন্য? কী নির্লজ্জ, কী নির্মম পরিহাস! সিলেটের বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতা ফরিদ গাজী যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করতে পারতেন, যুদ্ধশেষে যখন খালেদা জিয়াকে কৌশলগত কারণে পাকিস্তানীরা নিজেদের দায়ের বোঝা না বাড়িয়ে নিজেদের প্রাণ নিয়ে এবং জামায়াতের আমির গোলাম আযম জাতীয় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে মাথা হেঁট করে চলে গেল, তখন কিন্তু বড় ‘আদর-যতেœ’ পেলে-পুষে রাখা খালেদা জিয়াকে ঠিকানাবিহীন ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল, কেউ তাকে রক্ষা করতে এগোয়নি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সবাই তো আপনা জান বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল। তখন খালেদা ছুটে গিয়েছিলেন সিলেট, আওয়ামী লীগ নেতা ফরিদ গাজীর কাছে। মনে পড়ে কি ম্যাডাম সেদিনগুলোর প্রথম ন’মাসের আনন্দের দিন আর বাংলাদেশের বিজয়ে আপনার বিপন্ন দিনের সময়টাই... জানি মনের কোণে খোঁচা দিলেও ম্যাডাম আপনি সে কথা স্বীকার করবেন না। যখন ত্রস্তে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, তখন জিয়ার স্ত্রী পরিচয় ফিরে পাওয়াটাই আপনার বড় ছিল। কিন্তু জিয়ার মৃত্যুর পর লোভাতুর খালেদা তো রাজনীতিতে ভিড়ে গেলেন। সুতরাং আপনি স্বামী-গরবে গরবিনী গৃহবধূ থেকে সংসদীয় রাজনীতির নেতা হয়ে উঠলেন। খুব স্বাভাবিক, সামনে বিস্তর পারাবার ক্ষমতার। সে যদি হাতে যায় হঠাৎই, তাহলে তোয়াক্কা করার কীইবা আছে আপনার? তাই ঘটেছে। ভাগ্যে বিশ্বাস করি না কিন্তু তা নির্মম পরিহাস লক্ষ্য করছি বাধ্য হয়ে। এসব কথা বারবার বলতে ভাল লাগে না। শোভনও নয়। তবু আপনি নিজেকে এবং আপনার সাঙ্গপাঙ্গরা তো আপনাকে ‘একমেবাঅদ্বিতীয়ম’ মনে করে আর তাই সকলেই ‘দেহীপদপল্লবমুদারম’। এবার একটা মজাদার ঘটনার সংবাদ প্রত্যক্ষ করলাম সংবাদপত্রে, বিএনপির জাতীয় সম্মেলন হয়ে যাবার পর সুদীর্ঘ সময় ধরে ম্যাডাম তার দলকে ‘ময়দান উপযোগী’ মারকুটে জাতীয় কমিটিতে সাজাতে চিন্তাভাবনা, যোগ-বিয়োগ অঙ্ক কষছিলেন। এ অঙ্কের ইংরেজী হিসেব নতুন পদ্ধতিতে সল্্ভ করছেন লন্ডনের কোচিংয়ে ঋদ্ধ জ্ঞানে পোক্ত পলাতক তারেক জিয়া। তাই বোধহয় জাতীয় কমিটির নাম ঘোষণায় সাড়ে চার মাস সময় লেগে গেল বিএনপির। প্রায় ছয় শ’ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটির তালিকায় ফাঁসিতে ঝোলা যুদ্ধাপরাধীর ছেলে, আর তরুণ যুবদল-ছাত্রদলীয় সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি হয়েছে বড় রকমে। তাজ্জব হলাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকা মোসাদ্দেক আলী ফালু সবাইকে তাক লাগিয়ে ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকেই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এটা সত্যিই মিসটেরিয়াস। এ তো হবার কথা নয়। আব্দুল্লাহ আল-নোমান ও তার চিটাগোনিয়ান অনুসারীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে গণপদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন। খালেদা জিয়া নিরুত্তাপ আর তার সদ্য ভারমুক্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিক্ষুব্ধদের সবর করতে বলেছেন। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যারা মির্জা সাহেবকে ‘তিষ্ঠক্ষণকাল’ বলে বলে জিইয়ে রেখেছিলেন কয়েকটি বছর ধরে, তাদেরকে এখন তিনিই সবর করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে মির্জা সাহেবকে পুরনো ইতিহাস একটু মনে রাখতে অনুরোধ করব, খালেদা জিয়াÑ এই সেই নারী যিনি আপনারই ছাত্র ও রাজনৈতিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের সহকর্মী সতীর্থ আব্দুল মান্নান ভূইয়ার মতো দুঁদে রাজনীতিবিদকে কিভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিলেন ক্ষমতার জোরে, সে কথা মনে রাখবেন। কারণ তিনি বাংলাদেশে বসে লন্ডনে পলাতক তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেকের পরামর্শ ছাড়া কোন কাজই করেন না। দলের তোয়াক্কা না করেই মহাসচিব পর্যন্ত পাল্টাবার দৃষ্টান্ত আছে। ১/১১-এর সময় খালেদা জিয়া গ্রেফতারকালীন মুখে মুখে মহাসচিব বদল করেছিলেন এবং আব্দুল মান্নান ভূইয়াকে পদচ্যুত করে তার পরিবর্তে একই ঘরানার পুরনো রাজনৈতিক নেতা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে চলে যান। এই স্বৈরাচারী যথেচ্ছচার খালেদা জিয়ার করতে কোন ধরনের বাধা নেই। রাজনীতিহীন গৃহবধূর জীবন থেকে এসে তিনি এমনই পরনির্ভরশীল ছিলেন, এখনও নির্ভর করার লোক-লস্কর পাল্টান, তবে নীতিতে অটল থাকেন। তাই দেখছেন না, পাঠক, জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে কত ধরনের ‘ভানুমতীর খেল’ দেখাচ্ছেন?... তিনি ফালুর মতন বন্ধুকেও ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি। তবে ফালু অসুস্থ, ব্যাঙ্ককে না সিঙ্গাপুরে আছেন, সুস্থ হয়ে ফিরে এলে মান ভঞ্জনের কোন পালা অভিনীত হবে কিনা জানি না। নোমানের মতন জাত রাজনীতিকের ভাগ্যে যা জুটল, তা সংশোধন হবে কি না! তার জায়গায় তো আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে বেশি সক্রিয় সজীব বলে তুলে এনেছেন। নোমান অনেকটা বিনম্র স্বভাবের। ভদ্রোচিত রাজনীতির সংগঠক। কিন্তু এখন তো পাল্টাপাল্টির যুগ। সংহতি আর সংঘর্ষের যুগ। এখন ভদ্র, বিনম্র রাজনীতির খুব একটা পাত্তা নেই। বোধহয় চট্টগ্রামে দাবার বোর্ডে তাই ‘পণ’টা পাল্টে ফেলেছেন। চৌধুরী সাহেবকে রাজপথে বেশ সরব আমির বলেই ভেবেছেন বেগম জিয়া আর তারেক জিয়াও পছন্দ করেছেন হয়ত। যা হোক, এমন অসন্তোষ বহু জেলা থেকেই দেখানো হচ্ছে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল সান্ত¡না দিয়েছেন বঞ্চিত সবাইকে এবং প্রতীক্ষায় থাকতে বলেছেন। প্রতীক্ষা নয় সম্ভবত, অপেক্ষা করতে বলেছেন। তার নিজের যেমন হলো, তেমনিভাবে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ নীতি ধরতে বলছেন বোধহয় সবাইকে। তবে আমার একটা ধারণা জন্মেছে, তা হলো, যদি কোনভাবে পলাতক তারেক জিয়া মামলার মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখায় লন্ডনী দুঁদে আইনজ্ঞদের সহায়তায়, তখন কিন্তু মির্জা সাহেবের কপালে দুঃখ আছে। বিপদের সময় মাটি থেকেই মান্নান ভূইয়া বিএনপিকে টেনে তুলেছিলেন কিন্তু তাকেও ‘জবাই’ করতে খালেদা জিয়া বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। তাই ভাবছি, নাড়ি কাটার সময় মায়ের রক্তেই স্নাত হয় সন্তান, সুতরাং একই রক্তে কি ভিন্নগুণ থাকবে? নাকি মির্জা সাহেবকেও মান্নান ভূইয়ার ভাগ্যবরণ করতে হবে কি? ...নাও হতে পারে, যদি তারেককে মির্জা যথার্থ ব্রিফিং দিয়ে নিজের জায়গাটা পোক্ত হয়ত করেই ফেলেছেন। দেখা যাক, ভবিতব্য কী ভাবছে! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা রিজভী কিন্তু ইতোমধ্যেই বিএনপির ঘরোয়া নেতা হিসেবে তার ঘরে বসে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করতে করতে নিজেকে বেশ বিকশিত ও প্রকাশিত করেছেন। এ গুণ তার ছাত্রজীবন থেকেই ছিল। অর্থাৎ বক্তব্য রাখতে তিনি উস্তাদ এ প্রশিক্ষণ তার ছাত্রাবস্থা থেকেই। সেই সুবাদে বিএনপি ঘরানাতে সঙ্কটকালে তিনি বেশি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন বলে তার প্রমোশনও হয়েছে দলে। ...এবার যুবদল নেতা আলালসহ বহু তরুণের স্থান হয়েছে জাতীয় কমিটিতে। সাড়ে চার মাস ঢাকা-ল-ন চালাচালির পর ৫৯৬ সদস্যের বিশাল-বিকট কমিটি ঘোষিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোর নির্মম ব্যর্থতার কথা স্মরণ রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং ভাইস চেয়ারম্যান ঘুঁটি চেলে দল পাকিয়েছেন। মনে করছেন, রাজপথ এবার গরম করতে পারবেন। বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল বা অকার্যকর করার অপপ্রয়াস চালাতে নানা অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কোন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠনের মতো সাংগঠনিক শক্তি নেই বিএনপির, কেবল ছুটি ভোগ করে আর সরকারী দমন পীড়নের অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করতে চায় আর যা কর্মী আছেন, তাদের চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু হরতাল বা যে কোন সংগ্রাম বোঝানোর মতন কর্মসূচীর ডাক দিয়ে সব নেতা ঘরে বসে দিন কাটান, রাজপথে কাউকে দেখা যায় না। ফলে সব প্রয়াসই ব্যর্থতায় পর্যবসিত অতীতে হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে। ভাবছে এই জাতীয় কমিটিতে তারুণ্যের দাপট অন্তর্ভুক্ত করে এবার রাজনৈতিক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটাবে। তাই মাঝে মধ্যে দেউলিয়াপনার চূড়ান্ত দেখিয়ে বিদেশী দূতাবাস বা হাই কমিশনেও ধর্ণা দিয়ে নিজেদের ক্ষোভের কথা তাদের জানিয়ে সহানুভূতি পাবার কসরত করে কতটুকু পান, তা বিএনপি এবং পররাষ্ট্র বিষয় যারা দলে ডিল করেন, তারাই বলতে পারেন। ...এবার এই জাতীয় ‘কমিটির’ মারমুখী সদস্যদের জেলায় জেলায় রাজপথে সক্রিয় নেতা কর্মীদেরই নাকি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সরকারবিরোধী সংগ্রাম করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিন্তু সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে কি পৌঁছতে পারবে বিএনপি? দেখব আমরা জনগণ, কোথায় কেমন করে আন্দোলন করেন। তবে বিএনপি ভায়েরা আবার রাজনীতি করতে এসেছেন, দমন-পীড়নের অজুহাত দেখাবেন না। বিরোধী দলে থাকলে সরকারবিরোধী কর্মকা-ের জন্য নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবে, এটাই তো রাজনীতি। আমাদের মতন দেশে এমনই তো রীতিনীতি। কেন, নিজেদের আমলে কি করেছেন বিরোধী দলকে চিড়ে চ্যাপটা করার জন্য, সে কথা কি ভুলে গেছেন? শঠে শাঠ্যাং। ইট মারলে পাটকেলটি খেতেই হয়। তারপরও রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করাটাই হলো গণতন্ত্র, অন্তত আমাদের মতো দেশে তো বটেই। যে যখন ক্ষমতায় যাবেন, তখন যা যা করবেন, তা বিরোধী দলে গেলে ভুলে গেলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজনীতিকে আপনারাই প্রথম বিষাক্ত করেছেন। আপনাদের নেতা প্রতিষ্ঠাতা সমরনায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে সামরিকতন্ত্র পুনর্বহাল করলেন প্রিয় স্বদেশভূমিতে। তারপর ম্যাডাম জিয়া উত্তরাধিকারী হয়েছেন স্বামীর। এরশাদ অনেক স্বৈরাচারী ফাঁদ পেতে দশটা বছর প্রায় লুটে নিয়ে নিপীড়ন নির্যাতনের নতুন ইতিহাস গড়েছিলেন। সারাদেশের মানুষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন ১৪ দলীয় মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকারে। সেই যুদ্ধাপরাধী বিচার ও সাজা দেয়ার প্রশ্নে দেশে কোন কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে বিদেশের কোটি কোটি ডলার ঢেলে ‘লবিস্ট’ কিনে তাদের দিয়ে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা কম করেননি। তবু শেখ হাসিনা সরকার দ্বিতীয় দফায়ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখেছে জনগণের প্রবল মতানুসারে এবং কুখ্যাতদের মধ্যে কসাই কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, নিজামী, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতন জল্লাদদের ফাঁসি হয়েছে। সাঈদী কৌশলে আমৃত্যু কারাদ- ভোগ করছে। গোলাম আযম দ-ভোগ করতে করতেই মারা গেছে। সাঈদীর দ-াদেশের আপীল হয়েছে, ধনকুবের ‘রাজনৈতিক’ দল জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা মীর কাশেম আলীর রায়ের দিন হঠাৎ পিছিয়ে গেল। যা হোক, এ জাতীয় ফাঁসি বা আমৃত্যু দ-াদেশ ঘোষণার পর যারা চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখান মাইকে ঘোষণা দিয়ে, তারা যে কোন রায়ের পর একই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় ‘জামায়াতী হরতাল’ আবডালে বসে ডাকে। কিন্তু নজরে পড়ে না কেউ রাস্তাঘাটে। আগে যে টায়ার জ্বালাতো তাও এখন নেই। এখন ঐ হাওয়াই হরতাল ডেকে জনমনে ভীতির সঞ্চার করতে চায়, পারে না। আবার বিএনপি নেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া লটবহর নিয়ে গুলশানে তার দফতরে অর্ধশতাধিক অনুসারী পরিবৃত হয়ে তিন তিনটি মাস কাটিয়ে দিলেন হিংস্রতার আগুনে ঝলসালো শিশু বৃদ্ধ মহিলাÑ প্রায় আড়াই শ’ জনকে। কী নিদারুণ পৈশাচিক কা-কারখানা! এখানে কিন্তু বিএনপিপন্থী জামায়াত এবং জামায়াতপন্থী বিএনপির মিলন ঘটেছিল। তাই মানুষ হত্যা করে বিএনপি নেত্রী রাজনৈতিক পিকনিক এবং অর্ধশত সখা-সখীদের মিলনক্ষেত্র বানিয়ে বেশ চমৎকার দিন কাটিয়েছেন। মনে পড়ে ম্যাডাম, ফোনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলেছিলেন? প্রধানমন্ত্রী ম্যাডামের ছোট ছেলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে কি ধরনের ব্যবহার পেয়ে এসেছিলেন, জনগণ টিভির পর্দায় তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এই কি রাজনীতি সভ্যতার নিদর্শন? ম্যাডাম, আপনি তো দু’দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। দাবি করেন তিনবার। সে বিতর্ক নাইবা করলাম। এ কী করলেন? শোক জানাতে আসা প্রধানমন্ত্রীকে গুলশান দুর্গে ঢুকতে দিলেন না, দেখাও করলেন না, ফটক থেকেই তাকে বিদায় হতে হলো! আপনি পুত্রহারা হলেও সেদিন বোধহয় ‘কেমন দিলাম’ ভেবেছিলেন সাঙ্গপাঙ্গদের মোসাহেবীতে। না শেখ হাসিনাকে কেবল অপমানিত করেননি আপনি, গোটা রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণকে অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন। হাসিনা কিন্তু রাজনৈতিক সুস্থ আচরণ করেছিলেন এবং সহনশীলতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন সেদিন। রাজনীতিহীন রাজনীতির কী হিংসাত্মক পরিস্থিতিই না অবলোকন করলাম, যা এই সুদীর্ঘ জীবনে দেখিনি কোনদিন। এই হিংস্র মানসিকতার যে বহির্প্রকাশ যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল তার সাক্ষী হয়ে আছে। কেন অগ্নিসংযোগে ’৭১-এর জামায়াতী আলবদর দোসরদের মতো মানুষ মারবেন, দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়েছিলেনÑ সেই আপনি মানুষ মেরে কোন সুবিধা করতে না পেরে, বিদেশীদের করুণা ভিক্ষা করেও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারেননি, পরাশক্তির দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে পড়ে আছেন ম্যাডাম ক্ষমতারোহণের মওকা খোঁজার জন্য সেটা বুঝি। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। দাঁত ভাঙতে ও গলাতে পারছেন না, কী করবেন! ... জাতীয় কমিটি করেছেন, পানি বেশ ঘোলা হয়ে গেছে। নারী কুশলী সরকারের সমালোচনা করে বিরোধ মিটিয়ে নিজেরা শান্ত হতে চাইছেন ভাল। কিন্তু পারবেন কি? সত্যি বলছি ম্যাডাম, যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, তাহলে ময়দানে আসুন, রাজনীতি ময়দানেই হয়। ঘরে বসে চক্রান্ত করা যায়। ওটা ছেড়ে দিন। সংগঠিত কমিটির লন্ডন-ঢাকা সংগৃহীত ‘তারুণ্যসমৃদ্ধ’ সংগঠনকে এবার আদত রাজনীতিতে নামান। সরকারী দমন-পীড়ন আসবেই, কিন্তু তাকে ওভারকাম করে যদি ময়দানে না টিকে থাকতে পারেন তবে ভবিষ্যতে নিজেরাই টিকতে পারবেন না। জামায়াতকে ছাড়ুন। ওরা এতদিন ঘুণপোকার মতো কেটেছে, এমাজ উদ্দিন সাহেবদের মতন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আপাতত দূরে সরিয়ে পরে নির্বাচনে আবার বুকে টানার কৌশল ত্যাগ করুন, না হলে জনগণ আপনাদের একেবারে ত্যাগ করবেন। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×