ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চোখের সামনে দেখেছি সন্তানের মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ আগস্ট ২০১৬

চোখের সামনে দেখেছি সন্তানের মৃত্যু

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে জানান, সূর্যের কিরণ তখনও চারপাশ আলোকিত করেনি। ফজরের আযানের সুরেলা ধ্বনি চারদিক থেকে সুধা ঢালছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এমনই একসময় অতর্কিত হামলায় কেঁপে ওঠে ঢাকার ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িটি। যা বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদরদফতর। ঘাতকদের আগমনে ভীত চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত আশ্রয় চাইলেন মা শাহানারা আব্দুল্লাহর কোলে। কিন্তু মমতাময়ী মা তার আদরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারেননি। তার আগেই ঘাতকেরা মায়ের চোখের সামনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতকে। অশ্রুসজল নয়নে সেইদিনের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘বাবু আমার কোলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ধানম-ির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার বোনজামাতা ও তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িতেও হামলা করে ঘাতকেরা। সেখানে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে চার বছরের শিশু সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতও ছিলেন। মমতাময়ী মা শাহানারা বলেন, ‘সেদিন ফজরের আযানের পর আমরা প্রচ- গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। শব্দ আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও’। আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয়েছে, বলতে পারব না। এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছি না। মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, তারপরেও দেখো, কারা আসছে। এরমধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, কি ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে ফোন দিলা না? আমার শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি। উনার সঙ্গে কি কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগুবে না, ভাল হবে না। এ সময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন।’ অশ্রুসজল নয়নে শাহানারা আব্দুল্লাহ আরও বলেন, এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা রুমে রুমে ঢুকে হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইংরুমে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠব। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (শহিদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর অস্ত্র ঠেকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে উপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যে কারণে উপরের রুমগুলো তল্লাশি না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি। শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদের মারতে এসেছে, না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদের বলল, তোমরা কি চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকেরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই।’
×