ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের দিনে শক্তির অফুরান উৎস

লক্ষ মুজিবের কণ্ঠ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি...

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৫ আগস্ট ২০১৬

লক্ষ মুজিবের কণ্ঠ আকাশে বাতাসে ওঠে রণি...

মোরসালিন মিজান ॥ তোমার ছবি টাঙাতে পারি না ঘরে,/ তাই তো আমার দেয়াল শূন্য রাখি,/ আমার বুকের গভীর ভালোবাসায়/ উন্নতশির তোমার ছবি আঁকি...। প্রিয় পিতার ছবি বড় ভালবেসে বুকে এঁকে রেখেছে বাঙালী। মুজিব নামের ধ্রুবতারাটি সেই যে জ্বলেছিল, এখনও একই রকম জ্বলজ্বল করছে। আজ ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতার মহানায়ককে হারানোর দিন। বেদনাবিধুর এই দিনে আরও আরও প্রাণ পেয়েছেন অবিসংবাদিত নেতা। শোকের শহর ঢাকায় শক্তির অফুরান উৎস হয়ে এসেছেন তিনি। সভা-সমাবেশের মঞ্চ, শিল্পীর ক্যানভাস, ব্যানার-ফেস্টুন থেকে উঠে আসছেন শেখ মুজিব। কবির কবিতায়, শিল্পীর গানে বঙ্গবন্ধু। প্রধান প্রধান সড়কের পাশে স্থাপন করা তাঁর প্রতিকৃতি যেন বাংলার মুখ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সপরিবারে হত্যা করা হয়। কালো দিবসটিÑ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। এর পর বহুকাল গত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর গভীর ক্ষত শুকায়নি। বাংলাদেশের কপালে এখনও কলঙ্ক তিলক আঁকা। পিতা হত্যার পাপ যেন গিলে খেতে চায় বাঙালীকে। মুজিবের মতো নেতাকে রক্ষা করতে না পারার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন নির্দোষ নাগরিকও। দেশী-বিদেশী শত্রুরা ভেবেছিল, শিকড়শুদ্ধ উচ্ছেদ করা গেছে। আদতে মুজিব মৃত্যুঞ্জয়। মুজিব বাংলাদেশের অপর নাম। এ নাম কী করে মুছে যায়? তাই আরও বিপুলভাবে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন। কবির ভাষায়Ñ তার ছায়া দীর্ঘ হ’তে-হ’তে/ মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে...। বিশেষ করে শোকের মাসে আমূল বদলে গেছে রাজধানী শহর ঢাকা। যেদিকে চোখ যায়, শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি। বিলবোর্ড, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড সবখানে তিনি। আগস্টে বাঙালীর শৌর্যবীর্যের প্রতীক হয়ে ফিরে এসেছেন মুজিব। নতুন প্রাণ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গানের কথায়Ñ ‘একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণী...।’ শোকের এই দিনে মুজিবের স্মৃতিধন্য ধানম-ি ৩২ নম্বরে ঢল নামবে মানুষের। প্রিয় পিতার প্রতিকৃতির সামনে নীরবে দাঁড়াবেন সব বয়সী মানুষ। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সেভাবেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। রবিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি নয় শুধু; গুলিবিদ্ধ বাংলাদেশ। চোখ তুলে তাকাতেই মন বিষণœ হয়ে যায়। হু হু করে ওঠে বুক। লাল রক্তের ধারা যেন বইছে এখনও! শহরের অলিগলি-রাজপথেও শোক। শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রতিজ্ঞা। নানা আয়োজন। অনুষ্ঠান। সর্বত্রই অনিবার্য হয়ে মুজিব। তাঁকে ফিরে দেখা। শিল্পকলা একাডেমি শিল্পের আলোয় উদ্ভাসিত বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছে। জাতীয় চিত্রশালায় ১৪৮ শিল্পীর ১৫০ চিত্রকর্ম। শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেনÑ বিরেন সোম, আহমেদ সামসুদ্দোহা, শেখ আফজাল, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, মোঃ আলপ্তগীন, মোঃ কামাল উদ্দিন, ময়াজ উদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, মাকসুদুল আহসান প্রমুখ। প্রত্যেকেই নিজেদের কল্পনার রঙে জাতির জনককে এঁকেছেন। আর ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা শিল্পী প্রদ্যুৎ কুমার দাসের। চমৎকার একটি স্থাপনা শিল্প গড়েছেন তিনি। শিরোনাম করেছেন ‘ফ্রেম আউট’। সরল উপস্থাপনায় শিল্পী বলতে চেয়েছেন, সর্বত্রই এখন বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার প্রয়াস। যে যার মতো করে নামটি ব্যবহার করছেন। কিন্তু মহান নেতার আদর্শ বুকে লালন করছে ক’জন? প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পী। বুকে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখার, লালন করার আহ্বান যেন তার এই স্থাপনা শিল্পে। শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বাংলা ও ইংরেজী বইয়ের বিশেষ প্রদর্শনী। ‘জাতির জনককে জানুন’ শীর্ষক মাসব্যাপী আয়োজন দেখে সত্যি মুগ্ধ হতে হয়। এখানে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত তিন শতাধিক বাংলা ও ইংরেজী গ্রন্থ। আছে জীবনী গ্রন্থ, প্রবন্ধ, কবিতা, তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণসহ নানা রচনা। জাতির জনককে বিষয় করে লেখা বইগুলো দিয়ে সাজানো হয়েছে একটি আলাদা কোণ। সেখান থেকে পছন্দমতো খুঁজে নেয়া যাচ্ছে জাতির জনককে। বিদেশ থেকে প্রকাশিত ইংরেজী বইগুলো যথেষ্ট দুর্লভ। অধিকাংশ লাইব্রেরি বা বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না। সুযোগটি করে দিয়েছে পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র। বইয়ের প্রদর্শনী ছাড়াও এখানে প্রতিদিন থাকছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক আলোচনা, কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠসহ নানা আয়োজন। জাতীয় জাদুঘরে চলছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিদর্শনের প্রদর্শনী। ২৩ নম্বর গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে জাতির জনকের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে। বিয়োগব্যথা বুকে নিয়ে সেগুলো দেখছেন দর্শনার্থীরা। খুঁজছেন প্রিয় পিতাকে। গ্যালারির বেশ কয়েকটি শোকেসে বঙ্গবন্ধুকে লেখা মানপত্র। দেখতে সাদামাটা। জৌলুসহীন। দামী গ্লাস বা ফ্রেমে বাঁধানো নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য কী পরিমাণ শ্রদ্ধা আর ভালবাসা সাধারণ জনগণের হৃদয়ে জমা ছিল তা শতভাগ প্রকাশিত। কত যে আবেগ আর অনুভূতির রং দিয়ে সাজানো এক-একটি মানপত্র! বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া মানপত্রে ব্যথা-বেদনার স্মৃতি। বাঁধভাঙ্গা আবেগের সঙ্গে প্রকাশিত হয় ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের বরপুত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের দিকে ছাপা হওয়া কিছু পোস্টারেও খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুকে। এসব পোস্টারে সরকারপ্রধানের গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। একটি পোস্টারে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কঠিন।’ একই পোস্টারে মুজিবের উদ্ধৃতিÑ সমাজ থেকে দারিদ্র্য উৎখাত করতে না পারলে স্বাধীনতা হবে অর্থহীন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেয় এসব পোস্টার। নওগাঁর ভাতশাইল প্রগতি সংঘ পাঠাগার থেকে সংগ্রহ করা পোস্টার প্রথমবারের মতো জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্যালারিতে রাখা হয়েছে জাতির জনককে নিয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। অনেক আগের প্রকাশনা যেমন আছে, তেমনি আছে সাম্প্রতিক প্রকাশনা। পড়া বা হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রকাশনা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। গ্যালারির দেয়ালজুড়ে আছে আলোকচিত্র। এসব আলোকচিত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনাবহুল জীবন। ধারাবাহিক উপস্থাপনা। শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়। আজ পিতা হারানোর দিনে গোটা শহরজুড়েই থাকবে আরও অনেক আয়োজন। সব আয়োজন অনুষ্ঠান থেকে ফুলের মতো ফুটে উঠবেন মৃত্যুঞ্জয় মুজিব।
×