ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিমত ॥ রক্তস্নাত পনেরো আগস্ট

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৫ আগস্ট ২০১৬

অভিমত ॥ রক্তস্নাত পনেরো আগস্ট

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগের সব আগস্ট মাসই ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবার তথা বাঙালী জাতির জন্য আনন্দের মাস। কেননা, এই আগস্টের ৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এই আগস্টের ৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শেখ কামাল ভাই। তাই পারিবারিক উৎসব করার দুটি উপলক্ষ ছিল এই আগস্টে। কিন্তু সেই আগস্ট মাসই ১৯৭৫ সালে শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার মাসে রূপ ধারণ করল। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতির পিতা, বাঙালী জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করল একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও বেইমান খন্দকার মোশতাক-জিয়া-ফারুক-রশীদ-ডালিম গং। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল এবং দশ বছরের শিশু শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, কৃষকনেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও নিহত হন ১৫ আগস্ট। এ ছাড়া ঘাতকদের মেশিনগানের গুলিতে মোহাম্মদপুরে নিহত হন কয়েকজন সাধারণ মানুষ। যে মানচিত্র আঁকবেন বলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় জেলে কাটিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, নিজের সন্তানের ক্ষুধার চেয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকা একজন শিশুর খাদ্যের অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছেন, লাল-সবুজের পতাকা দিয়েছেন, সেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাঙালীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল হিমালয়সম। কিন্তু ঘাতকদের বুলেট সেই ইস্পাতকঠিন বিশ্বাসকে কাঁচের মতো ভেঙ্গে চুরমার করে দিল নিমিষেই। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় যখন ডিজিএফআইয়ের তদানীন্তন পরিচালক স্কোয়াড্রন লিডার আজিজ বঙ্গবন্ধুকে ঘুম থেকে তুলে তার অনুমতি প্রার্থনা করে বললেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে খুব সন্দেহপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটছে বলে আমরা ক্যান্টনমেন্ট সিলগালা করে দিতে চাই। সেই অটল বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু তার মাথায় স্নেহমাখা হাতের পরশ বুলিয়ে বললেন, ‘তুই খেয়েছিস? না খেয়ে থাকলে কামালের মাকে ডেকে তুলি, কিছু খেয়ে নে। ... ওরে আমাকে কেউ মারবে না। তোর মতো একই রকম কথা রোজ রাতে শুনে আমি ঘুমাতে যাই। আবার সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি আমি বেঁচে আছি। তোর কাছে একই কথা শুনলাম। এখন ঘুমাতে যা। কাল সকালে আসিস। তোর সাথে বসে সজনে ফুলের ভাজি দিয়ে একসাথে নাশতা খাব’। সেই নাস্তা করা আর হয়নি জাতির পিতার। বাঙালীর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রতিদানে কী পেলেন বঙ্গবন্ধু? যে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে প্রায়ই বলতো, বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় লাগার আগে আমার বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করতে হবে। যে জিয়াকে বঙ্গবন্ধু পরম স্নেহে বুকে টেনে নিয়ে সন্তানের মতো আদর করতেন, শেখ কামাল, জামালের মতো আদর করতেন। যে জিয়ার ভাঙা সংসার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু খালেদা জিয়াকে মেয়ের অধিকার দিয়ে। সেই জিয়া কিভাবে বললো, ঝড় যিধঃ ঢ়ৎবংরফবহঃ যধং নববহ শরষষবফ, ারপব-ঢ়ৎবংরফবহঃ রং ঃযবৎব ঃড় ঁঢ়যড়ষফ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে এবং সেই হত্যার সম্পূর্ণ নীলনক্সা অনুমোদন দিয়েছিল খুনী জিয়া। মনোবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় ‘ঠা-া মাথার খুনী’, জিয়া ছিল ঠিক তাই। সে খুব ভালভাবে ছক কষেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পরিস্থিতি থাকবে টালমাটাল, তাইতো সে সেই সময়ই ক্ষমতা গ্রহণ না করে যারা নতুন ক্ষমতায় বসেছে তাদের প্যারালাইজড করে পরে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। আর ক্ষমতায় বসেই মেজর জিয়া গোলাম আযমদের এদেশে ফিরিয়ে এনে পাকিস্তানবাদ রাজনীতি চর্চা শুরু করে। ১৯৭৫-এর ৩ নবেম্বর জেল হত্যার পর জিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র খুনীদের দেশ থেকে বের করে আনে এবং চাকরি দিয়ে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। খুনীদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি বানিয়ে দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে জিয়া সূচনা করে খুনীদের পুনর্বাসন। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জেলহত্যার পর ৪ নবেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনীদের একটি বিশেষ বিমানে রেঙ্গুন হয়ে ব্যাঙ্কক পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরে পাকিস্তান সরকারের দেয়া একটি বিমানে ব্যাঙ্কক থেকে তাদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। সব খুনীকে এক সঙ্গে লিবিয়ায় রাখা নিরাপদ নয় মনে করে ১৯৭৬ সালের ৮ জুন সাবেক সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতা মুজিবের রক্তস্নাত এই বাংলায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফেরানোর শপথ নিয়ে তিলে তিলে যে গণমুখী রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের বিপুল প্রত্যাশায় ও সমর্থনে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রিয় নেত্রী। তবে জীবনের ঝুঁকি সর্বক্ষণ। তারই মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা উপহার দেন আমাদের। ২০০১ সালে আবারও যখন দেশের শাসন ক্ষমতা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পরিপন্থী ও বিরোধিতাকারীদের হাতে চলে যায়, তখন বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে নির্যাতন-নিপীড়ন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের নির্যাতন-নিপীড়নের রূপ পরিগ্রহ করে। আমাদের প্রাণের নেত্রীকে প্রকাশ্যে ও গোপনে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা করা হয়। তন্মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সর্ব নিকৃষ্ট রূপ বিশ্ববাসী অবলোকন করে। তবুও প্রিয় নেত্রী থেমে থাকেননি। খালেদা-নিজামী শাসনামলে সুশাসন বঞ্চিত মানুষদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছেন। অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একক লড়াই করেছেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে পরাভূত করে এবং জনগণের দিগন্ত প্লাবিত সমর্থন নিয়ে তিনি ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বারের মতো ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রমকে সম্পন্ন করে বিচারের রায় বাস্তবায়ন করেছেন (কয়েকজন আসামি পলাতক)। শোককে শক্তিতে পরিণত করে, এক রক্তগঙ্গা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃপ্ত শপথে আমরা যখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছি, যখন বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঠিক তখনই বিএনপি-জামায়াতের দোসররা, পাকিস্তানের পরাজিত শক্তিরা এক হয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদী ছোবল মারছে। সাম্প্রতিক সময়ের জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে জড়িতদের পারিবারিক পরিচয় আমাদের সে বিষয়েই সম্যক ধারণা দেয়। উদাহরণ স্বরূপ কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গী আকিফুজ্জামান খানের কথা বলা যায়। আকিফুজ্জামান খান সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনায়েম খানের নাতি। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে। জাতির পিতা হত্যাকা-ের ৪১তম শোকাবহ মাস চলছে এখন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কিন্তু তাদের আদর্শেই বেড়ে ওঠা তাদের সন্তানরা, দোসররা, তাদের হাতে গজানো রাজনীতিবিদরা এখনও এ দেশকে পূর্ব পাকিস্তান বানানোর দুঃস্বপ্নে বিভোর। সবচেয়ে সতর্কতার বিষয়, একাত্তরের এই পরাজিত শক্তি বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক, এই ধন-সম্পত্তি ব্যবহৃত হচ্ছে দেশবিরোধী নাশকতায়। তাই এই শোকের মাসে সবার প্রতি উদাত্ত আহ্বান, আসুন আমরা সবাই নিজেদের নাগরিক দায়িত্বটুকু পালন করি। যে দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু সপরিবারে আত্মত্যাগ করেছেন, সেই দেশের জন্য আমাদের মেধা, শ্রম, সততা, নিষ্ঠা, সর্বোপরি দেশপ্রেমকে নিবেদন করি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, নেতার ঐক্য চাই না, জনতার ঐক্য চাই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে একাত্তর সালে মুক্তি পাগল জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেমন পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক তেমনি দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ তথা সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, লড়তে হবে আপ্রাণ। বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এ আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য। এ থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×