ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

যে রাতে দুয়ার ভেঙেছিল ঝড়ে

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৫ আগস্ট ২০১৬

যে রাতে দুয়ার ভেঙেছিল ঝড়ে

সে রাতে আমাদের দুয়ারগুলো ভেঙেছিল ঝড়ে। এমন প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পূর্বাভাস মেলেনি সম্ভবত কারও মনে। কিন্তু ঝড় এসেছিল বাংলার বুক জুড়ে। রক্তমাখা সে ঝড়ে ঝরে গিয়েছিল বাংলার ভাগ্য। কেমন ছিল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ভোর রাতটি? গত সপ্তাহে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও মোনাজাত শেষে সে দিনের বেদনাবিধুর স্মৃতিগুলো মানসপটে ভাসতে থাকে। ১৮ বছর বয়সী সুকান্তর কবিতার মতো স্পর্ধা ছিল অমিত তেজের। তখন ঢাকা কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আমাদের কাছে ঘটনাটি ছিল হৃদয়বিদারক। আমাদের বিশ্বাসে কোনভাবে ঠাঁই নিতে পারেনি এমন মর্মান্তিক ঘটনা যে ঘটতে পারে। বেতারের ঘোষণাগুলো বিষময় হয়ে আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছিল। যেমন করত একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদারদের দখলে থাকা ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত ঘোষণাগুলো। বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার ও স্পর্শ পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল পঁচাত্তরের সতেরো মার্চে জন্মদিনে। ধানম-ি শাখা চাঁদের হাটের একদল সদস্যসহ আমরা সকালেই গিয়েছিলাম বত্রিশ নম্বরের বাসভবনে। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে সাব্বির রহমান বাপ্পি গাইছিল, ‘আমরা সূর্যের সাথী’ গানটি। তারই সুরে আমার লেখা গানটিতে কণ্ঠ মেলাচ্ছিলাম আমরা। প্রভাতফেরির মতো সারিবদ্ধভাবে পৌঁছেছিলাম বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বসার ঘরে তখন ফুল নিয়ে আরও বহু অভ্যাগতজন। অনেকে ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলেন। আমরাও। বঙ্গবন্ধুকে আমরা ক’জন পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলাম। তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘খাঁটি বাঙালী হিসেবে তোরা বড় হবি। দেশকে গড়ে তুলবি।’ মুগ্ধতার আবেশে পূর্ণ হয়ে আমরা সেদিন আবেগাপ্লুত যেন। আর এ ঘটনার ক’মাস পর তিনি খুন হয়ে যাবেনÑ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না মন। এক করুণ মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক মুহূর্ত ছিল সেদিনের ভোর আমার কাছে যেমন, তেমনি সাধারণ বাঙালীর কাছেও। পরীক্ষার কারণে কলেজে ক্লাস না হলেও আমরা নিয়মিত ক্যান্টিনে আড্ডা বসাতাম। যাদের অধিকাংশই ছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। ১৪ আগস্ট আমরা দুপুর পর্যন্ত ক্যান্টিনে। জানা ছিল, পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে যোগ দেবেন। বিকেলে শহরের কয়েকটি স্থানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সবারই ধারণা ছিল, জাসদ ও গণবাহিনী বঙ্গবন্ধুর ক্যাম্পাসে আসার প্রতিবাদ জানাতে এই বোমাবাজি করছে। ঢাকা কলেজে জাসদের সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকলেও সমর্থক ছিল। আমরা তাদের চিনতাম, জানতাম। তবে তারা খুব উগ্র ছিল, তা নয়। পরীক্ষার কারণে আমাদের ভোর রাতে ঘুম থেকে ওঠে পড়াশোনা করতে হতো। সে রাতেও ভোর চারটায় ঘুম ভেঙ্গে বাসায় পড়ার টেবিলে আমি এবং আমার আরেক সহপাঠী। আমরা তখন থাকি ভূতের গলিতে নর্থ-সার্কুলার রোডে, বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে খুব দূরে নয়। তখন হাইরাইজ ভবন ছিল না। তাই ভোর রাতের গুলি ও কামানের শব্দগুলো মনে হচ্ছিল কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না, গোলাগুলি কোথায় হচ্ছে। ধারণা করছিলাম, জাসদ ও গণবাহিনী সম্ভবত গোলাগুলি করছে। ঢাকা বেতার তখন ভোর সাড়ে ছ’টায় চালু হতো। রেডিওর ‘নব’ ঘুরাতেই শুনতে পেলাম পাকিস্তানী উর্দু ঢঙে উচ্চারিত মেজর ডালিমের কণ্ঠ এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে বারবার ঘোষণা প্রচার হতে থাকে। ততক্ষণে অবজারভার ও ইত্তেফাক পত্রিকা পেয়ে গেছি হকারের বদৌলতে। পত্রিকা দুটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ওপর। হতভম্ভ আমরা রাস্তায় নেমে দেখি স্টেনগান হাতে সিপাহীরা কিছু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঘরে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়। সকাল দশটার পর কলেজে গিয়ে দেখি সহপাঠী ঝাঁকড়া চুলের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লালবাগের বাসা থেকে হেঁটে ক্যান্টিনে চলে এসেছে। সঙ্গে আরও সহপাঠী শাজাহান মাখন, জুয়েল, ফারুক, চঞ্চল খান, সানি। কিছুক্ষণ পর হাজির হলো আদমজী থেকে কবি কামাল চৌধুরী। এভাবে আরও অনেকে। এর মধ্যে মাসুম পারভেজ রুবেলকে দেখলাম তাদের আরেকজন বন্ধু নিয়ে ক্যান্টিনে এসে ফিসফিস করে কী কথা বলছে। আমাদের কারও মুখে কোন কথা সরছিল না। একেকজন একেক রকম কথা বলছিল। কলেজ ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি সৈয়দ নুরু ক্যান্টিনে এসে আমাদের জানালেন মহাবিপর্যয় ঘটে গেছে। আমাদের প্রতিবাদে প্রতিরোধী হতে হবে বলে তিনি মিনিট পাঁচেক বক্তব্য রেখে চলে গেলেন। রুদ্র ও কামাল চাইছিল আমরা যেন দল বেঁধে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাই। কিন্তু রুবেল (পরে চিত্রনায়ক) জানাল, পথে পথে সেনাবাহিনী গাড়ি থামিয়ে ‘চেক’ করছে। তারপরও আমরা চাইছিলাম যতদূর যাওয়া যায় যাব। কলেজ গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই দু’জন সিপাহী রুদ্রকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গেল। দেখলাম তাকে রাস্তার ওপারের একটি সেলুনে নিয়ে যাচ্ছে। তার ঝাঁকড়া চুল উধাও হয়ে গেল। আমরা হতভম্ব। যে যার বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মর্মঘাতী হত্যা আমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বিঘœ সৃষ্টি করেছিল। কি হবে পরীক্ষা দিয়েÑ এমন একটা মনোভাব তখন বন্ধুদের মধ্যে। যথারীতি পরীক্ষার আসনে বসতে হলো নটরডেম কলেজে। গেটে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। পরীক্ষা চলাকালেই জেলহত্যার ঘটনা ঘটে। সে অন্য কাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হওয়ার পর আমরা দেখলাম, ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানাও নেই। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দেখাও মেলে না। এরই মাঝে ছড়াকার আলতাফ আলী হাসুর উদ্যোগে বের হলো ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?’ নামে কবিতা সংকলন। তাতে আমরাও লিখেছিলাম। ক্যাম্পাসে সাতাত্তর সালেই কবিতা পাঠের আসর বসালাম মধুর ক্যান্টিনের সামনে। আমরা ক’জন কবিতা পাঠের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার প্রতি মাগফেরাত কামনা করলাম। এভাবে ক্যাম্পাসে-ক্লাসে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। কবি কামাল চৌধুরী লিখলেন ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম’। ক্রমশ আরও অনেক কবি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে কবিতা লিখেছেন। সেসব পাঠের জন্য ক্যাম্পাসে কবিতা পাঠের আসর বসত প্রায় প্রতি মাসেই। আমরা বঙ্গবন্ধু অনুসারীরা ক্যাম্পাসে দেয়াল লিখনের জন্য উদ্যোগী হলাম। ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর সহযোগিতা পেয়ে গেলাম। দেয়াল লিখনের ভাষ্য নির্ধারণের দায়িত্ব পড়ল আমাদের ওপর। কবি কামাল চৌধুরী লিখলেন ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে’Ñ কলাভবন, কার্জন হল, মহসীন হল, জহুরুল হক হল, শহীদুল্লাহ হলের দেয়ালে ভেসে উঠল এই বাক্য। আরও একটি লাইন পেলাম এই কবির কাছ থেকে ‘মুজিবর আছে বাংলার ঘরে ঘরে, বাঙালীর অন্তরে।’ এই দুটি সেøাগানই সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ততদিনে পেয়ে গেলাম গায়ক, সুরকার লিয়াকত আলী লাকীকে। কামাল, আমি, আলতাফ আলী হাসুর লেখা গান সুর দিয়ে গাইতে শুরু করে লাকী। আমরা গড়ে তুললাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংস্কৃতি সভা।’ ১৯৭৯ সালের পনেরোই আগস্ট উপলক্ষে ছাত্রলীগের সংগঠনের নামকরণ করা হলো কবি কামালের বিখ্যাত লাইনÑ ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে।’ ক্যাম্পাসের দেয়ালজুড়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বাণী উদ্ধৃত করে দেয়াল লিখনের কাজও শুরু হলো। মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্রলীগকর্মী হায়দার আলীর সঙ্গে মিলে আমরা ক’জন রাত দশটার পর কলাভবনের দেয়ালজুড়ে উৎকীর্ণ করতাম বঙ্গবন্ধুর বাণী। ‘নক্ষত্রবীথি’ নামে চার পাতার একটি কবিতা পত্রিকা আমি এবং খায়রুল আনোয়ার মুকুল ও বদরুল হুদা চৌধুরী মিলে প্রতিমাসে বের করি। তাতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতা ছাপা হতো। মাঝে মধ্যে দু’একজন হুমকি দিতোÑ এসব বন্ধ করার জন্য। এরা ছিল চৈনিকপন্থী, গলাকাটা রাজনীতির ধারক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধুহীন অবস্থায় অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল ছাত্র রাজনীতি থেকে। ছাত্রলীগের সাহসী নেতারা ক্যাম্পাসে আশা-যাওয়া শুরু করেন। তার মাঝে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সম্মেলন সাহস বাড়িয়ে দেয় নেতাকর্মীদের মধ্যে। ক্রমশ সবাই প্রকাশ্য হতে থাকেন। ১৯৭৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ ও আমিসহ ৪ জন সদস্য নির্বাচিত হবার পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সমর্থক বাড়তে থাকে। এরপর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক সংকলন প্রকাশ হয়। বোস প্রফেসর আবদুল মতিন চৌধুরী আটাত্তর সালে টিএসসিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছাত্রসমাজকে উদ্দীপিত করেছিল সেদিন। এরপর তিনি গঠন করেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার কাজ চালু করেন। এই পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়েছিলাম আমি ও কামাল চৌধুরী। আমরা টের পাচ্ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর নাম যারা মুছে দিতে চেয়েছিল, তারাও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার কাজ থেকে সরে আসছিল। আর বঙ্গবন্ধু তখন জেগে উঠেছিলেন বিশাল মহীরুহ হয়ে। পনেরোই আগস্ট রাতে আমাদের জ্ঞান-সাধনার যে দুয়ারগুলো ঝড়ে ভেঙ্গেছিল, সেই দরজা পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি আমরা ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের বিশ্বাসে তখন নাড়া দিয়েছিল যে, শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতিÑ একই জীবনের দু’রকম উৎসারণ। সেই বিশ্বাসবোধ আমাদের সারাদেশে নিয়ে গিয়েছিল : কবিতা পাঠ ও সাহিত্যের আসরে। আমরা প্রতিটি আসরে বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ করে কবিতাপাঠ করতাম। ঝড়ের বিরুদ্ধে আমরা ততদিনে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। সেই সব স্মৃতি আমার জেগে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে। মনে পড়ল সেই কবিতা, যা আটাত্তরে লেখাÑ ‘একটি ডাকে জেগেছিলাম সাত কোটি প্রাণ রণাঙ্গণে/স্বাধীনতার সোনার স্বপন হারালো আজ কোনখানে/মুজিব তো নেই, মুজিব তো নেই/ভালবাসা হারালো সেই/মুজিব মাঝে পেয়েছি যে এই জীবনের সত্য মানে।’
×