ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

উনিশ শ’ পঁচাত্তর থেকে দুই হাজার ষোলো

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৪ আগস্ট ২০১৬

উনিশ শ’ পঁচাত্তর থেকে দুই হাজার ষোলো

রাত পোহালেই জাতীয় শোক দিবস। রাষ্ট্র এবং সমগ্র জাতি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে আগামীকাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানাবে এবং হৃদয়ের স্পর্শে অনুভব করবে তার উপস্থিতি। প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে উদ্ভাসিত তাদের মুজিব ভাই হাসিমাখা অমলিন মুখে বলবেন- কি বলছিলাম না বাঙালীকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। হাসুর নেতৃত্বে তোমরা অনেক দূর এগিয়েছ, আরো যাবে। তোমরা ভয় পাবে না। এখন কিছু ছিন্নমূল কাপুরুষ জঙ্গী ও তাদের দোসররা তোমাদের কিছু করতে পারবে না, আমি সদা-সর্বত্র তোমাদের পাশেই আছি। শেখ মুজিব মানেই হলো বাঙালীর শক্তি, অফুরন্ত শক্তি। এ শক্তিকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না, ফিনিক্স পাখির শক্তি। এ কথাগুলো আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের নয়, বলেছেন সর্বজনগ্রাহ্য বিখ্যাত সব প-িত ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তিন দিনের মাথায় ১৮ আগস্ট লন্ডনের খ্যাতনামা পত্রিকা দি লিসনার মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপলো। বলা হলো- শেখ মুজিব রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত তাঁর বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারকচিহ্ন এবং তাঁর কবরস্থান পুণ্যতীর্থেও পরিণত হবে। এই ভবিষ্যত বাণীটি আজ সত্য হয়েছে। একটি অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে, মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে, নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য যে পথ দেখিয়েছেন এবং নিজের জীবন ও কর্মের ভেতর দিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা পৃথিবীতে বিরল। একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতৃত্বের সর্বাচ্চ সোপানে অধিষ্ঠান। কিন্তু চরিতকাল স্বল্প। এই স্বল্প সময়ে রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলী ও তার সফল বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটন ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে। অকুতোভয় সাহস, দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি, সীমাহীন ত্যাগ, সর্ব প্রকার বস্তুগত প্রলোভনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান, মানুষের প্রতি নিখাদ ভালবাসা, মানবতার প্রতীক ক্ষমা করার উদারতা, প্রতিহিংসা-প্রতিশোধমুক্ত মন, সব কিছুই তিনি আত্মস্থ করেছেন স্বল্প জীবনের পরিসরে। আর এর মূল উৎস ছিল বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ। এরকম একজন মহামানবের মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর আজ আমরা ৪১টি বছর পেরিয়ে আসছি। ১৯৭৫ আর ২০১৬ অবশ্যই এক নয়। সব কিছু বদলেছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করেছেন সেটির নেতৃত্বের আসনে এখন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে নিয়ে যেসব স্বপ্ন দেখতেন সেগুলোর অনেক কিছুই আজ তার আদরের হাসুর হাত ধরে ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে এবং বাকিটুকুও অর্জিত হওয়ার মহাসড়কে উঠে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনের লেখা থেকে জানা যায়Ñ একবার বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তার স্থলে বাংলাদেশের নেতৃত্বে আগামীতে কে আসছেন। বঙ্গবন্ধু নাকি উত্তর দিয়েছিলেন- ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না। তবে আমার মনে হয় এমন একজন আসবেন, যার কথা এখন এই মুহূর্তে আমরা কেউ ভাবতে পারছি না। পঁচাত্তরপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালে বঙ্গবন্ধুর এই কথার যথার্থতা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিবারের সবাই নিহত হলেও তাঁর দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কিভাবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তা এখন শুধু বাঙালী নয়, বিশ্ববাসীও জানে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ওই বছরই নবেম্বর মাসের ৩ তারিখে জেলখানার ভেতর বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মাধ্যমে শত্রুরা ভেবেছিল কেল্লাফতে! মুজিবের নাম নেয়ার মতো আর কাউকে বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। ৪১ বছর পর আজ বলা যায় ওই মূর্খের দল মানব সভ্যতার ইতিহাস পড়েনি, তারা জানত না যে দর্শনের জন্য মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ মানুষ অকাতরে জীবন দিতে পারে তা কেবল দর্শনের প্রবর্তককে হত্যা করে স্তব্ধ করা যায় না। ক্ষমতার অন্ধ মোহে সেই নির্বোধেরা ভেবেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সব কিছু করে ফেলবে। মুজিবের দর্শন আর কোনদিন বাংলাদেশে ফিরে আসবে না। কিন্তু বিদেশে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এলে পঁচাত্তরের শত্রুরাই প্রমাদ গোণে এবং দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আজকের জঙ্গীবাদ ও জঙ্গী তৎপরতা এই লড়াইয়েরই অংশবিশেষ। আজকের চলমান যুদ্ধের শুধু কাল ভিন্ন, বাকি স্থান, লক্ষ্য এবং পক্ষ-বিপক্ষ সবই এক ও অভিন্ন। এই লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য তারা ২০-২১ বার অপচেষ্টা করেছে, যার সর্ববৃহৎ বহির্প্রকাশ ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এটি রাজনৈতিক লড়াই, এটি আদর্শের লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন ভার্সেস পঁচাত্তরের পরে পুনরুত্থান হওয়া দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক দর্শন। দুটি দর্শন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, একসঙ্গে সহঅবস্থান অসম্ভব। এই সত্যটি শত্রুপক্ষ জানে ও বোঝে। লড়াইটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক গ-ির মধ্যে থাকতে পারত। কিন্তু এক পক্ষ ভাল করে জানে তাদের রাজনৈতিক চেতনার শক্তি অতি দুর্বল ও আধুনিককালে অচল। তাই শুরু থেকেই তারা অস্ত্রের পন্থা বেছে নিয়েছে। তারা জানে না ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হিসেবে খ্যাত নেপোলিয়ন সেন্ট হেলেনার নির্জন দ্বীপের কারা জীবনে উপলব্ধি করেছিলেনÑ তলোয়ার ও চেতনা, এই দুই শক্তির মধ্যে শেষ বিচারে চেতনার শক্তিরই জয় হবে। জীবনের শেষ চিঠিতে নেপোলিয়ন কিশোর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন- অস্ত্রের বলে নয়, যৌক্তিকতার বলে মানুষকে বশে আনতে হবে (গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি, জ. নেহেরু-পৃ. ৩৯১-৩৯২)। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যুক্তি আধুনিক বিশ্বে অগ্রহণযোগ্য, তাই তারা প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছে এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত রেখেছে। চলমান যুদ্ধে বাইবেলে বর্ণিত শুভশক্তির প্রতীক ডেভিডের প্রতিনিধিত্বকারী মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের জয় হবে, আর অশুভ শক্তির প্রতীক গলিয়াথের প্রতিনিধিত্বকারী উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পরাজয় হবে। শঙ্কা হলো, কঠিন এবং মহাকঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে দ-ায়মান। এই চ্যালেঞ্জের বহুরূপ, বহু শাখা-প্রশাখা দেশে-বিদেশে ও ঘরের ভেতরে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুও তার জীবদ্দশায় ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও যুদ্ধের আভাস পেয়েছিলেন। প্রস্তুতি যে নেননি তা নয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তখন বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় সে সময়ের শত্রু ও আসন্ন যুদ্ধের স্বরূপের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কর্তৃক রচিত নাটক ‘পলাশী থেকে ধানম-ি’ শীর্ষক গ্রন্থে। বইয়ের ১০২ নম্বর পৃষ্ঠায় বর্ণিত একটা সংলাপে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকে বলছেন- আমার দলের ভেতরে, সরকারের ভেতরেও এখন পঞ্চম বাহিনী ঢুকেছে। এখন আমাদের স্বাধীনতার শত্রু ঘরে-বাইরে। আমাকে তাই নতুন যুদ্ধে নামতে হবে। এই যুদ্ধ একাত্তরের যুদ্ধের চাইতে শক্ত যুদ্ধ। ফলাফল কি হবে এখনও তা জানি না। শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রের আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় ওই বইয়ের ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায়। খোন্দকার মোশতাক এক সংলাপে তাহের ঠাকুর ও ওবায়দুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেছেন- শেখ মুজিবের চারপাশে এখন কোন প্রকৃত বন্ধু নেই। আর্মি, সিভিল সার্ভিস, নিউজ পেপার- সর্বত্র আমাদের লোক ঠিকঠাক জায়গায় বসে গেছে। ১৯৭৫ থেকে ২০১৬, ৪১ বছর পেরিয়ে শেখ হাসিনা এখন বঙ্গবন্ধুর জায়গায় ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় আছেন। দেশের সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বিস্ময়কর অর্জন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার অবস্থান শক্তিশালী। কিন্তু তারপরেও ওই নাটকে উল্লিখিত দুটি সংলাপের কথার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কতটুকু পার্থক্য আছে, সেই প্রশ্নটি আজ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আশার জায়গাও আছে। বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি তরুণ আজ মুজিব দর্শনে উদ্বুদ্ধ। তাদের কাছে এখনও বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা- শুধু মনে মনে সমর্থন দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। জানতে হবে, বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে, সক্রিয়ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হবে। মুজিবের রক্ত বৃথা যেতে পারে না, বৃথা যাবে না। এই রক্তের অমোঘ শক্তি আছে। লেখক : ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×