ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না ॥ ড. মসিউর

খুলনা ও যশোর অঞ্চলে বিদ্যুত সরবরাহ বাড়ালে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৪ আগস্ট ২০১৬

খুলনা ও যশোর অঞ্চলে বিদ্যুত সরবরাহ বাড়ালে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি ঐ এলাকায় এ ধরনের একটি প্রকল্প হওয়া উচিত। কারণ বৃহত্তর খুলনা ও যশোর অঞ্চলে যদি আমরা বিদ্যুত সরবরাহ বাড়াতে পারি তাহলে কোন ধরনের বাড়তি বিনিয়োগ ছাড়াই ঐসব অঞ্চলে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। তবে সরকারকে সুন্দরবনের স্বার্থও খতিয়ে দেখতে হবে। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে দেশের জ্বালানি সমস্যা সমাধানের তাগিদ দেন অর্থ উপদেষ্টা। এজন্য বিদ্যুতের বড় ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থায়নে ‘দীর্ঘমেয়াদী বন্ড’ ইস্যু করার প্রস্তাব করেন তিনি। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ইস্যুজ এ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অব ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজার অব লার্জ এ্যান্ড মেগা পাওয়ার প্রজেক্ট’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই কার্যালয়ে সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির সভাপতি হোসেন খালেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মসিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল-ইসলাম। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিদ্যুত বিভাগের সাবেক সচিব মোঃ ফৌউজুল কবির খান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা বলেন, রামপাল এখন বিতর্কে পরিণত হয়েছে। এটা সঠিক কারণে হতে পারে, বেঠিক কারণেও হতে পারে। কিন্তু আমি অনেকদিন ধরেই সেখানে একটি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের সমর্থক ছিলাম। সমর্থনের কারণ হিসেবে মসিউর বলেন, খুলনা অঞ্চলে এক সময় অনেক পাটশিল্প ছিল। কিন্তু এখন খুলনা শিল্পহীন হয়েছে। খুলনা ও যশোরের মধ্যে ৬০ কিলোমিটার রাস্তার পাশে অনেক মাঝারি কারখানা আছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে তারা তাদের উৎপাদনক্ষমতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে না। এসব কারখানায় বিদ্যুত-গ্যাস দেয়া গেলে ভবিষ্যতে কোন ধরনের অতিরিক্ত বিনিয়োগ ছাড়া উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। মসিউর রহমান বলেন, আমার কাছে যে তথ্য আছে তা হলো, সুন্দরবনের সংরক্ষিত অঞ্চলের চার থেকে ছয় মাইল দূরে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রটি হবে। তবে সেখানে যদি কোন ইস্যু (বিষয়) থাকে, তাহলে তা আরও সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, এতে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা আরও বলেন, বিদ্যুতের বড় ও মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন একটি অন্যতম ইস্যু। যা দীর্ঘমেয়াদী বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ করার বিষয়ে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পক্ষ হতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এছাড়া এই প্রকল্প সফল হতে প্রযুক্তিও অন্যতম। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বিদ্যমান কর নীতিমালাকে যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক হতে হবে। এছাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার সফলতার জন্য ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, ৬-৮ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনীতির জন্য খুব বেশি উদ্বেগের বিষয় নয়। সেমিনারে বিশেষ অতিথি পরিকল্পনা বিভাগের সচিব তারিক-উল-ইসলাম বলেন, ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন বিদ্যুতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুত খাতের উন্নয়নে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়। যার আলোকে এখন অনেক মেগা প্রকল্প হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কিছু এলাকায় সোলার প্রকল্প নির্মাণের পরে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়েছে। যা নিয়ে সোলার প্রকল্প নির্মাণকারীরা বিপদে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবগত আছে। আর বিদ্যুতের মেগা প্রকল্প পাস করতে যে ২-৩ বছর লেগে যায়, তা সমাধানেও কাজ করা হচ্ছে। পরিকল্পনা সচিব আরও বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ এখন বড় বাধা। আর এ সমস্যার সমাধানে অচিরেই বাজেটে আলাদা থোক বরাদ্দের সুযোগ রেখে একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। ভবিষ্যত জ্বালানি চাহিদা মোকাবেলায় হাইড্রো পাওয়ার কিংবা সোলার পাওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহারেরও তাগিদ দেন পরিকল্পনা সচিব। সেমিনারে বিদ্যুত বিভাগের সাবেক সচিব মোঃ ফৌউজুল কবির খান তার মূল প্রবন্ধে বড় ও মেগা পাওয়ার প্রকল্পে অর্থায়ন, সমস্যা ও সমাধানের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রকল্পে অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য ব্যালেন্স শীট, জমি অধিগ্রহণ, দরপত্রের প্রক্রিয়া, সীমিত ঋণ যোগ্যতা, আইনী প্রক্রিয়া, ক্রয় নীতিমালা এবং পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পটি জ্বালানি খাতকে সহায়তা করছে না, বরং অহেতুক বিতর্ক তৈরি করছে। তাই এটি সরিয়ে নেয়া উচিত। অবশ্য জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিদ্যুতকেন্দ্রটি সুন্দরবনের ক্ষতি করবে না। তাদের হাতে এ সংক্রান্ত ভাল সমীক্ষা আছে। সুন্দরবন দেশের ১৬ কোটি মানুষের সম্পদ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটির ক্ষতি হয় কিনা, তা দেখা সরকারের দায়িত্ব। মোহাম্মদ হোসেন আরও বলেন, বর্তমানে সরকার ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করছে। তিনি জ্বালানি খাতের অর্থায়নের বহুমুখীকরণের ওপর জোরারোপ করেন। তিনি জানান, সরকার তার ক্রয়কৃত বিদ্যুতের ২০-৩০ শতাংশ দেশী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত বিদ্যুত ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট তানভির এ সিদ্দিকী বলেন, জ্বালানি খাতের প্রকল্পসমূহে অর্থায়নের লক্ষ্যে ফান্ড গঠন-সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারকে উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এ ধরনের প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়া আরও সহজীকরণ করা জরুরী। ডিসিসিআই সভাপতি হোসাইন খালেদ বলেন, বলিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত ছাড়া শিল্পায়নের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সময়মতো অর্থায়ন নিশ্চিত না করার কারণে অনেক সময় স্থ’ানীয় ও জয়েন্ট ভেঞ্চার উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুত খাতে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য ‘ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এ্যান্ড ফিন্যান্সিং ফেসিলিটির (আইপিএফএফ)’- মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় ‘পাওয়ার ফিন্যান্সিং ফান্ডিং ফেসিলিটি’ প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআইর সহসভাপতি হুমায়ুন রশিদ বলেন, বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জ্বালানি আমদানির বিষয়টি ভবিষ্য আরও বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে, তাই ভবিষ্যত জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের দেশীয়ভাবে উৎপদানকৃত কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
×