ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়োগ ব্যথার আগস্ট

দুর্লভ স্মৃতি নিদর্শন, প্রিয় পিতাকে খুঁজে ফেরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৪ আগস্ট ২০১৬

দুর্লভ স্মৃতি নিদর্শন, প্রিয় পিতাকে খুঁজে ফেরা

মোরসালিন মিজান ॥ ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে স্বাধীনতা,/ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে/ মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি...। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কল্পনা করে লিখেছিলেন শামসুর রাহমান। প্রিয় কবিতার চমৎকার উপস্থাপনা গ্যালারির এককোণে। গ্লাসশোকেসে মানপত্র। চিঠি। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে নিয়ে লেখা গ্রন্থসম্ভার। দেয়ালের সাদা-কালো ছবিতেও তিনি। এভাবে নানা ভাব ও ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার প্রয়াস। বেদনা বিধুর ১৫ আগস্ট সামনে রেখে শনিবার থেকে বিশেষ এই আয়োজন করেছে জাতীয় জাদুঘর। ২৩ নম্বর গ্যালারিজুড়ে এখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন। বিয়োগ ব্যথা বুকে নিয়ে সেগুলো দেখছেন দর্শনার্থীরা। খুঁজছেন প্রিয় পিতাকে। দিনের শুরুতে জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে ছিল বঙ্গবন্ধু স্মৃতি বক্তৃতা। আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে একক বক্তৃতা করেন কবি কামাল চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কবি নুরুল হুদা। এই পর্ব শেষ হতেই সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি নিদর্শন দিয়ে সাজানো গ্যালারি। জাতীয় জাদুঘরে শেখ মুজিবুর রহমানের বেশ কিছু দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। সবগুলো গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় না। স্টোরে সংরক্ষণ করা নিদর্শনের একটি অংশ নিয়ে শোক দিবসের আয়োজন। বেশ কয়েকটি গ্ল্যাসশোকেসে বঙ্গবন্ধুকে লেখা মানপত্র। দেখতে সাদামাটা। জৌলুসহীন। দামী গ্লাস বা ফ্রেমে বাঁধানো নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য কী পরিমাণ শ্রদ্ধা আর ভালবাসা সাধারণ জনগণের হৃদয়ে জমা ছিল তা শতভাগ প্রকাশিত। কত যে আবেগ আর অনুভূতির রং দিয়ে সাজানো এক একটি মানপত্র! বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া মানপত্রে ব্যথা বেদনার স্মৃতি। বাঁধভাঙ্গা আবেগের সঙ্গে প্রকাশিত হয় ইতিহাস। আর এ ইতিহাসের বরপুত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মৌলানা আজাদ কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ দেয়া মানপত্রে লেখা হয়- যখন ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার শোকে মুহ্যমান ছিলাম, তখন তোমার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও মৃত্যুঞ্জয় আদর্শ বারবার আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে। ফরিদপুরের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া মানপত্রের ভাষাটি এরকম- কর্ম ও সেবার অনুপ্রেরণা হয়ে বাংলা মায়ের কোলজুড়ে, আমাদের মাথার মুকুট হয়ে থাক। কালি বা ছাপার অক্ষরে যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে চিঠি বা মানপত্র লিখেছেন কেউ কেউ। তেমন একটি মানপত্রের লেখক একজন ভারতীয় নাগরিক। নিজের রক্ত দিয়ে দীর্ঘ পত্র রচনা করেন তিনি। বহু বছরের ব্যবধানে রক্ত শুকিয়ে বিবর্ণ হয়েছে। তবে লেখাগুলো এখনও পড়া যায়। এতে তিনি লিখেছেন- ‘দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে একটি শ্রেণী তথা একটি জাতি চেয়েছিল- একটা অবলা জাতির ওপর সামন্ততান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, আমলাতান্ত্রিক, শোষণপূর্ণ রোলার চালিয়ে একটা জাতিকে শান্তিকামী দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে উচ্ছেদ ঘটাতে তারা চেয়েছিল দ্বিজাতি মনোভাব নিয়ে ধর্মের জিগির তুলে সরলপ্রাণ মানুষের মনের চাওয়াকে চিরতরে রুদ্ধ করে এক অর্থবিহীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করতে- তারা চেয়েছিল দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য জিঁইয়ে রেখে আমলাতন্ত্রের কতগুলো মুখোশধারী শয়তানকে সর্বহারা মানুষের বুকের ওপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দিয়ে তাদের দাবিকে চিরতরে রুদ্ধ করতে... কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা শুধু পটে আঁকা ছবিই রয়ে গেল।’ বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে লিখেছেন। গ্যালারিতে আছে সেসব চিঠিও। ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া বেগম ৫৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্র লেখে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ লেখা পত্রটি এখনও ফ্রেমে বাঁধানো। এর শিরোনাম- একটি নাম একটি শপথ। এতে জাতির জনকের নামের প্রতিটি অক্ষর ভেঙ্গে নতুন নতুন অর্থ করা হয়েছে। সব শেষে লেখাটি দাঁড়িয়েছে এ রকম- ‘মান রাখব এই বাংলার শপথ করি এসো সবাই মিলে।’ ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের দিকে ছাপা হওয়া কিছু পোস্টারেও খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুকে। এসব পোস্টারে সরকার প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান। একটি পোস্টারে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কঠিন।’ একই পোস্টারে মুজিবের উদ্ধৃতি- সমাজ থেকে দারিদ্র্য উৎখাত করতে না পারলে স্বাধীনতা হবে অর্থহীন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা দেয় এসব পোস্টার। নওগাঁর ভাতশাইল প্রগতি সংঘ পাঠাগার থেকে সংগ্রহ করা পোস্টার প্রথমবারের মতো জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। গ্যালারিতে রাখা হয়েছে জাতির জনককে নিয়ে লেখা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। অনেক আগের প্রকাশনা যেমন আছে, তেমনি আছে সাম্প্রতিক প্রকাশনা। পড়া বা হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রকাশনা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। গ্যালারির দেয়ালজুড়ে আছে আলোকচিত্র। এসব আলোকচিত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘটনাবহুল জীবন। ধারাবাহিক উপস্থাপনা। শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়। সবশেষ ছবিটির সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসা। সিঁড়িতে গুলিবিদ্ধ জাতির পিতা। বিশাল বুক শত্রুর বুলেটে বিদীর্ণ। বের হয়ে আসতে আসতে মনে প্রশ্ন জাগে, ক্ষত বিক্ষত হয়েছিল মুজিবের বুক? নাকি বাংলাদেশের হৃদয়?
×