ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগের অবস্থানে নেই তুরস্ক ॥ সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৪ আগস্ট ২০১৬

আগের অবস্থানে নেই তুরস্ক ॥ সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসছে

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- ঘিরে ঢাকা-আঙ্কারার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলেও এখন আর তা নেই। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। প্রায় তিন মাস পাল্টাপাল্টি অবস্থানের পর দুই দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নিজ নিজ মিশনে ফিরেছেন। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছে দেশটি। এদিকে ঢাকার তুরস্ক দূতাবাসের তিনজনসহ বিভিন্ন মিশনে নিযুক্ত মোট ৩২ কূটনীতিক সেদেশে ফেরত যাননি। জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-ের পর ঢাকা-আঙ্কারা পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছিল। ঢাকা থেকে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্ককে আঙ্কারায় ডেকে নেয়ার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকীকে ঢাকায় ডেকে আনা হয়েছিল। প্রায় তিন মাস পর গত বুধবার আল্লামা সিদ্দিকী তুরস্কে বাংলাদেশ মিশনে ফিরে গেছেন। আর বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্ক শুক্রবার ঢাকায় ফিরে কাজে যোগ দিয়েছেন। নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর গত ১২ মে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান গভীর পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্ককে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আঙ্কারা। ঢাকা থেকে যাওয়ার তিন মাস পরে গত ১২ আগস্ট ফিরে আসেন ওয়াসতুর্ক। ঢাকা থেকে আঙ্কারায় ফেরার পরে সেখানে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তিনি। তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেয়া হলেও দেশটির নিজস্ব গণমাধ্যম খবর দেয় তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার থেকে বলা হয়, তুরস্ক তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করার বিষয়ে কিছু জানায়নি। কোন দেশের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। তবে এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেয়ার পরপরই তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকীকেও ডেকে নিয়ে আসা হয়। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুতে তুরস্ক অব্যাহতভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সেখানে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। গত ১৫ জুলাই রাতের এই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা সামলাতেই এখন ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট এরদোগান। সে কারণে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে নাক গলানোর মতো সময় এখন নেই এরদোগান সরকারের। অনেকটা বাধ্য হয়েই যুদ্ধাপরাধ বিচার ইস্যু থেকে সরে এসেছে দেশটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন এরদোগান। গুলেনের সঙ্গে যোগসাজশ থাকার সন্দেহে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনী, শিক্ষা ও বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের হাজার হাজার কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে এরদোগান সরকার। তাদের অনেককেই গ্রেফতারও করা হয়েছে। এছাড়া দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিন শতাধিক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান এরদোগানের সাজানো নাটক বলে পাল্টা অভিযোগ করে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা তারই এক সময়ের রাজনৈতিক বন্ধু গুলেন। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে পাকিস্তান বরাবরই তাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেও তুরস্কের সুর ছিল নরম। তুরস্ক কখনই শক্তভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে নিজামীর ফাঁসির পর তুরস্ক বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নেয়। তারা ঢাকা থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান স্বয়ং বিষয়টি দেখভাল করেন। তিনি ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওয়াসতুর্ককে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই তুরস্ক এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সর্বশেষ মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর দেশটির প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছিল। এছাড়া ২০১১ সালে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকেও যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দেশটি। তবে বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না বলেও তুরস্ককে জানানো হয়েছিল। ৩২ কূটনীতিক দেশে ফেরত যাননি ॥ তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় দেশটির বিভিন্ন মিশনে নিযুক্ত কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব কূটনীতিককে দেশে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়া হলেও তারা ফিরে যাননি। বিশ্বের বিভিন্ন মিশন থেকে দেশটির ৩২ কূটনীতিক বাইরের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত তিন কূটনীতিকও তুরস্কে ফিরে যাননি। ঢাকার তুরস্ক দূতাবাসের চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্স আহমেদ গুরবুজ, তৃতীয় সচিব সেমিলেনুর গুরবুজ ও এ্যাটাশে পদে কর্মরত এক কর্মকর্তা ঢাকা থেকে নিজ দেশে ফেরত না গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে আশ্রয় নিয়েছেন। তুরস্ক সরকারের অনুরোধে এই তিন কর্মকর্তার কূটনৈতিক পাসপোর্টও বাতিল করেছে বাংলাদেশ।
×