ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিয়া ও তামিম কি আটক!

মীর কাশেমের রিভিউ সামনে রেখে আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ আগস্ট ২০১৬

মীর কাশেমের রিভিউ সামনে রেখে আত্মঘাতী হামলার আশঙ্কা

শংকর কুমার দে ॥ শোকের মাস, জাতির জনকের মৃত্যুবার্ষিকী ১৫ আগস্ট, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার ২১ আগস্ট দিবস ও ২৪ আগস্ট মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর সর্বোচ্চ আদালতে রিভিও শুনানিকে সামনে রেখে বড় ধরনের আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার আশঙ্কা আছে বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী কি আটক? গুলশানের জঙ্গী হামলার আরেক মাস্টারমাইন্ড মারজান (সাংগঠনিক নাম) কোথায়? রাজধানীতে ব্লকরেডে ধরা পড়া সুইসাইড স্কোয়াডের ৬ জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র‌্যাব ও গোয়েন্দারা। গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিমকে এই প্রথমবারের মতো গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফের ৮ দিনের রিমান্ড ও কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানকে ৫৪ ধারার মামলায় আবারও ৬ দিন রিমান্ড দিয়েছে আদালত। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র থেকে জানা গেছে, জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন ঢাকাতেই আছেন তারা। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন ইউনিটের পক্ষ থেকে সরাসরি স্বীকার না করলেও গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে, ঢাকাতেই আছেÑ এমন ধরনের মন্তব্যের তথ্য বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দেয় তারা গোয়েন্দা জালে আটকা পড়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, রাজধানীতে ব্লকরেডের মধ্যেই তারা ধরা পড়ে থাকতে পারে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম ও কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানকে জিম্মি অবস্থায় উদ্ধার ও ছেড়ে দেয়ার পর প্রায় মাসাধিকাল ধরে নিখোঁজ থাকার সময়ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। তারপর দেখা গেল তারা গ্রেফতার হয়েছেন, আদালতে হাজির করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল হক জিয়া ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীর বেলায়ও এমন ধরনের ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয় বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড মারজানের নাম (সাংগঠনিক নাম) পাওয়া গেছে তদন্তে। শুধু তাই নয়, সে ঢাকাতেই আছে বলে জানানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। রাজধানীতে একের পর এক ব্লকরেড দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে সুইসাইড স্কোয়াড দলের ৬ সদস্যকে গ্রেফতারের পর মারজানের নাম ও তার ঢাকায় থাকার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সুইসাইড স্কোয়াডের গ্রেফতারকৃত ৬ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে সিফাত (২৭), জাহিদ হাসান ওরফে মাইন (২১), মোঃ নয়ন হোসেন (২১), জাহিদ আনোয়ার ওরফে পরাগ (২২), মোঃ জিয়াবুল হক (২৪) এবং মোঃ তাজুল ইসলাম ওরফে তাজুল (২৯)। তাদের উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় এনে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলা ও আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আগামী ১৫ আগস্ট জাতির জনকের মৃত্যুবার্ষিকী, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার দিন ও মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ শুনানির দিন ২৪ আগস্টকে সামনে রেখে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। এজন্যই উত্তরবঙ্গ থেকে সুইসাইড স্কোয়াডের জঙ্গী গ্রুপকে ঢাকায় এনে জঙ্গী আস্তানা গড়ে তোলা হচ্ছে। রাজধানীতে অভিযানকালে ৬ জঙ্গী ধরা পড়লেও আরও অন্তত ৫ জঙ্গী পালিয়ে গেছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, যে ৬ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, দেশে বিভিন্ন জঙ্গী হামলার পর ‘আত-তামকীন’ নামে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মিডিয়াতে নিজেদের আইএস হিসেবে প্রচার করত তারা। যে কোন জঙ্গী হামলার পর এ চক্রটিই আইএস পরিচয়ে দায় স্বীকার করে দেশ-বিদেশে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করত। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জঙ্গী সংগঠন আইএসের নামে দায় স্বীকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসা এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করাই হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমÑ বিশেষ করে ফেসবুক, ইমো ছাড়াও টেলিগ্রাম, থ্রিমার মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিত। আত-তামকীনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করে থাকে সংগঠনটির সদস্যরা। এর মধ্যে একটি গ্রুপ অনুবাদের কাজ করে, একটি ফটোশপের কাজ করে, আরেকটি গ্রুপ ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ এবং অন্যটি প্রচারের কাজ চালায়। এ দলের সদস্যরাই এখন পর্যন্ত ১১টি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে গুলশান, শোলাকিয়া, মাদারীপুরে শিক্ষকের ওপর হামলাসহ মোট ১১টি হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও স্বীকার করেছে। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জেএমবির এই সুইসাইড স্কোয়াড গ্রুপের জঙ্গীরাই শোকের মাস আগস্টের বিভিন্ন দিবসকে সামনে রেখে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। হাসনাত করিম ৮ দিনের রিমান্ডে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মামলায় এই প্রথম আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিমকে। আদালতে হাজির করা হলে তাকে ৮ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেয়েছে পুলিশ। তবে হাসনাতের সঙ্গে উদ্ধার কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খানকে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়নি। শনিবার তাকে ৫৪ ধারার মামলায় আবারও ৬ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আদালত। শনিবার ঢাকার মহানগর হাকিম ইমদাদুল হকের আদালতে হাসনাতের পক্ষে রিমান্ড বাতিলের আবেদনও করা হয়। তার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মাহবুবুল আলম দুলাল। হাসনাতের রিমান্ড বাতিলের আবেদন বাতিল করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার ৮ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার দুই দিন পর সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করে পুলিশ। জঙ্গী হামলার পরদিন কমান্ডো অভিযানে সেখান থেকে উদ্ধার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাতকে সন্দেহের কথা জানালেও এক মাস পর তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। শনিবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ওই ঘটনায় জঙ্গী হামলা চালিয়ে হত্যাকা-ের মামলায় তাকে হেফাজতে নিয়ে ৮ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক হুমায়ুন কবির হাসনাতকে ১০ দিন হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেছিলেন। হাসনাতের সঙ্গে উদ্ধার তাহমিদ হাসিব খানকেও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিনের হেফাজতে নেয়া হয়। তাকে গুলশান হত্যাকা-ের মামলায় গ্রেফতার না দেখিয়ে ৫৪ ধারার মামলাতেই আরও ৭ দিনের রিমান্ডে চায় পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ গোলাম নবী ৬ দিন মঞ্জুর করেন। তাহমিদের পক্ষে জামিন আবেদনও করেন তার আইনজীবী। জামিনের আবেদন নাকচ করে তাকে রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। ডিএমপির উপকমিশনার মোঃ মাসুদুর রহমান বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশী হাসনাতকে গত ৪ আগস্ট ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হলেও হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। প্রথম দফায় হাসনাতকে ৮ দিন জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হামলায় তার জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা, সে বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা মুখ খোলেননি। গুলশান হামলায় হাসনাতের এক সময়ের কর্মস্থল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিবরাস ইসলাম নিহত হওয়ার আগে হামলার সময় ধারণ করা কিছু ভিডিওতে তার গতিবিধি গোয়েন্দাদের সন্দেহের উদ্রেক হয়। গত ২ আগস্ট হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় অভিযান শেষে উদ্ধার ১৩ জনসহ ৩২ জনকে নেয়া হয়েছিল গোয়েন্দা কার্যালয়ে। জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই-বাছাই করে তাদের অনেককে ছেড়ে দেয়া হলেও হাসনাত ও তাহমিদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের না পাওয়ার কথা জানানো হয়। এর কয়েক দিন আগে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছিলেন, গুলশানের ঘটনায় উদ্ধার পাওয়া হাসনাত করিম সন্দেহমুক্ত নন। হাসনাতের পরিবারের দাবিÑ মেয়ের জন্মদিন উদযাপনে ওই দিন সপরিবারে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন হাসনাত। গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যার পরপরই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে হাসনাতের সম্পৃক্ততার কথা জানানো হয়। নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে হাসনাতকে ২০১২ সালে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল বলে গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে অনেকে লেখেন ফেসবুকে। বাংলাদেশে নজিরবিহীন এ হামলায় আইএস দায় স্বীকার করে পাঁচ হামলাকারীর ছবি প্রকাশ করলেও বরাবরই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দেশীয় জঙ্গী দল জেএমবিকে দায়ী করা হচ্ছে।
×