রিও অলিম্পিক শুরুর আগে থেকেই বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনায় ছিলেন তিনি। ধারণা ছিল অলিম্পিকের বড় মঞ্চে এবার একটা চমক থাকবেই তার। বাস্তবে সেটাই ঘটলো। রিও এ্যাকুয়াটিক সেন্টারে মিডিয়াকর্মীদের ভিড়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আবদার মিটিয়ে যাচ্ছিলেন সবার। একটি মাত্র স্বর্ণপদক জিতে হয়ে উঠলেন বিশ্বতারকা। তিনি জোসেফ ইসহাক স্কুলিং। তার হাত ধরেই আসলো সিঙ্গাপুরের অলিম্পিক ইতিহাসে প্রথম সোনা। তাও যেনতেন কাউকে হারিয়ে নয়। ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে এই মুহূর্তে বিশ্ব সাঁতারের অবিসংবাদিত মহাতারকা মাইকেল ফেলপসকে পেছনে ফেলে। আর এ কারণেই আলো ছড়িয়ে দিলেন গোটা রিও অলিম্পিক গেমসে।
যেদিন থেকে জলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা শুরু, সেদিন থেকে ফেলপসই তার গুরু। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আইডলের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে। তখন কে জানতো বছর আটেক পরে সময়ের পথ পরিক্রমায় তার জীবনে অপেক্ষা করছে এক অভূতপূর্ব নাটকীয় মুহূর্ত। সেদিন কে জানতো গুরু ফেলপসকে হারিয়েই অলিম্পিকের ইতিহাস বদলে সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের জন্ম দেবেন ২১ বছর বয়সী টগবগে এই যুবক। অলিম্পিকে নিজের তো বটেই মাতৃভূমির জন্য সোনা এনে দিয়ে ইতিহাসও গড়লেন তিনি। আট বছর আগে ফেলপসের মুখোমুখি সাক্ষাতই যেন ছিল তার জীবনের অনুপ্রেরণার মন্ত্র। সেদিনই যেন আগামী ইতিহাসের এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। রিওতে স্থানীয় সময় রাত সড়ে ১০টায় ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে জোসেফ যখন শেষ করলেন, তখন তার পিঠে পড়লো ¯েœহের হাত, সে হাত ফেলপসেরই। যাকে অলিম্পিকে ২৩তম সোনা জয় থেকে বঞ্চিত করলেন জোসেফ স্কুলিং। কিন্তু ভক্তের কাছে এ হার বোধহয় সন্মানেরই। আর পিঠ চাপড়ে সেই সন্মানটুকু ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করলেন না ‘বাল্টিমোর বুলেট’। এ যাবত সিঙ্গাপুর অলিম্পিকে চার চারটি পদক জিতেছে। কিন্তু এতদিন সে দেশের ইতিহাসে কোন সোনা ছিল না। তা সম্পূর্ণ হলো স্কুলিংয়ের হাত ধরে। এদিকে নিজের ছোটবেলার হিরোকে হারানোর অদ্ভুত অনুভূতি, অন্যদিকে দেশের হয়ে প্রথম সোনা জেতাÑ ইতিহাসের উদযাপন যেন এই মুহূর্তে উপচে পড়ছিল স্কুলিংয়ের ঝুলিতে। আর তাতে কেমন অনুভূতি তার? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ভাবতেই পারি না কিভাবে হয়ে গেলে। দেশের জন্য আমি এমন একটা কাজ করতে পেরেছি যা কেউ কখনও ভাবতে পারেনি। এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি পেরেছি। এ্যাকুয়াটিক সেন্টারে গ্যালারি থেকে যে সমর্থন পেয়েছি তা অভূতপূর্ব, বিরাট আনন্দের। আর ফেলপসকে হারানোর এমন একটা অনুভূতি যা সারা জীবনেও আমি ভুলতে পারব না, জানাচ্ছেন স্বুলিং। অলিম্পিকে শনিবার রাতে ২৩তম সোনার মেডেল গলায় ঝুলাতে পাারেননি ফেলপস। তবে ভক্তের কাছে হেরে তিনি কি বলেছেন? হারলে কেউ খুশি হয় না। স্বাভাবিক আমিও খুশি নই। কিন্তু যোসেফের জন্য আমি গর্বিত। মনে মনে একদিন ফেলপসকে ছুঁতে চেয়েছিলেন যোসেফ। নিজের দক্ষতায় সেই ফেলপসকে টপকে যেতে পেরেছেন তিনি। আর ফেলপস? ভক্তের কাছে পরাজয়ের মধ্যেও যে আনন্দ আছে, ক্যারিয়ারের এই প্রান্তে এেেস সে অনুভূতি ছুঁয়ে গেল কিংবদন্তি সাঁতারুকে। ক্যারিয়ারে অজস্র সোনা পেয়েছেন। এবার সোনা পাননি এই ইভেন্টে। কিন্তু এই অনুভূতিও যে সোনার চেয়ে কম খাঁটি নয় তার কাছে, তাই যেন বুঝাতে চাইলেন সাঁতারের বিস্ময়-মানুষ ফেলপস।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে বড় হয়ে ওঠা স্কুলিং টেক্সাস ইউনিভার্সিটির হয়ে জিতেছেন অনেক পদক। ২০১৪ সালে ইনচন এশিয়ান গেমসের ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনা জেতার পর দু’বছরে নিজেকে তৈরি করেন রিও অলিম্পিকের জন্য। আর সেটা খোদ টেক্সাসে থেকেই, পড়াশুনার সুবাদে। পরাজয়ের পর ফেলপস যতোই ভক্তের কাছে পরাজয়ের আত্মতৃপ্তির কথা বলুন না কেন, এটা মানতেই হবে টেক্সাসে বসবাস করে যুক্তরাষ্ট্রের বুকেই আঘাত হেনেছেন স্কুলিং। ৫০ দশমিক ৩৮ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন ৬ ফুট উচ্চতার যোসেফ স্কুলিং। আর ৫১ দশমিক ১৪ সেকেন্ড পেছনে পড়ে গেলেন ফেলপস।
ইনচন এশিয়ান গেমসে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনার পাশাপাশি ৫০ ও ২০০ মিটারে জিতেছিলেন সিলভার ও তাম্র। একই বছর গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সিলভার, ক্রমেই পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে যোসেফ স্কুলিংকে। আর তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন অলিম্পিকে পদক জেতার। আর সেটা যে আইডল ফেলপসকে হারিয়েই পূরণ করবেন তিনি কল্পনা করেননি। কিন্তু দৃঢ় মনোবল আর আত্মবিশ্বাস, স্কিল দেখিয়ে সেটা পেরে বনে গেলেন সিঙ্গাপুরের মহানায়ক। তাও অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে।