ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

রাসেলের জন্য

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১৩ আগস্ট ২০১৬

রাসেলের জন্য

বত্রিশ নম্বর সড়কের দশ নম্বর বাড়ির চারপাশে কঠিন নিরাপত্তা। আশপাশ দিয়ে মানুষের চলাফেরার কোন উপায় নেই। এক সপ্তাহ ধরেই চলছে নিরাপত্তার কাজ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। প্রধানমন্ত্রী আসবেন। আসবেন আরও মন্ত্রী। আসবেন দেশের গণ্যমান্য অনেক ব্যক্তিবর্গ। জুবেদ আলী বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরছেন। মনমরা। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাড়ি। গোঁফগুলো সাদা। মাথার চুলও কাঁচাপাকা। পরনে লুঙ্গি। গায়ে একটা জরাজীর্ণ জামা। জুবেদ আলী প্রতি বছরই ১৫ আগস্ট এই বাড়িতে আসে। সে বাড়িতে থাকতে পারে না। তার বাড়ি অনেক দূর। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানায়। অন্যবার এসে বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরে সারাদিন থেকে চলে যায়। এবার এসেছে সে অন্য একটা মতলবে। গতকাল রাতে সে ট্রেনে এসে কমলাপুর স্টেশনে রাত কাটিয়ে খুব ভোরে বত্রিশ নম্বর সড়কের পাশে চলে আসে। তার জামার নিচে লুকিয়ে এনেছে একটি ব্যানার। ব্যানারটি রাখাতে বুকের কাছটা ফুলে আছে। চারদিকে নিরাপত্তা কর্মীদের চলাফেরা। তাদের গায়ে বিভিন্ন পোশাক। কারও কাছে অস্ত্র। আশপাশে মানুষের ভিড় জমছে। ভিড় ঠেলে জুবেদ আলী সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তার বুকের দিকটা ফোলা কেন? এক নিরাপত্তা কর্মী তাকে ধরে এক পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। পুলিশও তাকে কয়েক দফা মারধর করে থানায় নিয়ে যায়। জুবেদ আলী মার খেয়ে কথা বলতে পারছে না। যদিও কয়েকবার বলতে চেয়েছে, স্যার, স্যার। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই তাকে মার খেতে হয়েছে। মার খেয়ে সব কথা গুলিয়ে গেছে মনে। ধানম-ি থানায় তুমুল হুলস্থুল পড়ে গেল। দুষ্কৃতকারী ধরা পড়েছে। তার জামার ভেতরে অস্ত্র পাওয়া গেছে। থানার পুলিশ সদস্যদের অস্থির অবস্থা। ওসি সাহেব একজন হাবিলদার ডেকে বললেন, ওরে রাম ধোলাই দাও। হাবিলাদার তাকে একটা থাপ্পড় দিতেই জুবেদ আলী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জরাজীর্ণ চেহারা। শরীরে মাংস বলতে নেই। এমন মানুষটি কী করে দুষ্কৃতকারী হয়? এই ভাবনা থেকে হাবিলদার জুবেদ আলীর পাশে গিয়ে বসেন। জুবেদ আলী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল, স্যার একটু পানি খাওয়াবেন? তাকে পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। হাবিলদার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সত্যি সত্যি দুষ্কৃতকারী? কোন মতলবে আসছিল? জুবেদ আলী আধমরা। সে কথা না বলে জামার ভেতর থেকে একটি কাপড়ের ব্যানার বের করে দেয়। ব্যানারের এক মাথায় একটি বাঁশের কাঠি। হাবিলদার ব্যানারটি খোলে। ব্যানারে লেখা, ‘১৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক শিশুনির্যাতন ও শিশুহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক। ঘোষণা করতে হবে।’ লেখাটি দেখে হাবিলদারের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। নির্বাক হয়ে জুবেদ আলীর দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এই কাজ করতে এসেছো কেন? জুবেদ আলী কথা বলতে পারছে না। তার গায়ে কোন শক্তি যেন নেই। অনেকক্ষণ পর বলল, রাসেল আমার বন্ধু ছিল। আমরা তখন বস্তিতে থাকতাম। তার মৃত্যু আমি এখনও মানতে পারি না। তাই প্রতি বছর দেশের বাড়ি থেকে এখানে এসে বাড়িটি দেখে যাই। চোখের পানি ফেলি। জুবেদ আলী জামার নিচ থেকে ছোট শিশুর একটা জামা বের করে হাবিলদারের হাতে দেয়। রাসেল যে বছর মারা গিয়েছিল তার আগের বছরের ঈদে আমারে এই জামাটা দিয়েছিল। সেই স্মৃতিটা এখনও ধরে রাখছি। স্যার, আমি দুষ্কৃতকারী না। আমি রাসেলের বন্ধু। হাবিলদার জামাটি হাতে নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে। তার চোখ থেকে দরদরিয়ে পানি পড়তে থাকে।
×