ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়েই যেতে হয় পরপারে

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৩ আগস্ট ২০১৬

ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়েই যেতে হয় পরপারে

পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে বিয়ে মানেই যৌতুক। আর যৌতুক মানেই গরু। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের আগে পাত্রপক্ষের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হয় গরু। বহু কাল আগ থেকে চলে আসছে এ প্রথা। যৌতুক নিরোধ আইন, সামাজিক আন্দোলন কিংবা প্রশাসনের চোখ রাঙানি থেকে শুরু করে কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা এ প্রথাকে উচ্ছেদ করতে পারেনি। বরং যৌতুকের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে চরাঞ্চলের অসংখ্য পরিবার প্রতিবছর দায়দেনার জালে জড়িয়ে পড়ছে। হচ্ছে সর্বস্বহারা। এটাই চরাঞ্চলের বাস্তবতা। অন্যদিকে নদ-নদীতে ভেসে বেড়ানো মানতা সম্প্রদায়ের মাঝেও যৌতুক নামের এ ব্যাধি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না অধিকাংশ পরিবার। এ সম্প্রদায়ের যৌতুক মানেই নতুন নৌকা। যা নবদম্পতির সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, তাদের ঘাড়ে আজও জগদ্দল পাথরের মতো যৌতুক নামের সামাজিক ব্যাধি চেপে বসে আছে। ছেলেমেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে যেমন প্রথায় রূপ নিয়েছে, তেমনি যৌতুক ‘ঐতিহ্যে’ পরিণত হয়েছে। আর অধিকাংশ পরিবারে যৌতুক মানেই কমপক্ষে একটি গরু। পাত্রপক্ষের যা ‘ন্যায্য পাওনা’। রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নে চরগঙ্গা ও চরহালিম পাশাপাশি দু’টো দ্বীপচর। সাগরঘেঁষা এ দু’টো দ্বীপচরে হাজার দুয়েক পরিবারের বাস। এ দু’টো দ্বীপচরে গত দু’বছরে অন্তত ৩০টি বিয়ে হয়েছে। যার পাত্রপাত্রীরা প্রায় সকলেই অপ্রাপ্তবয়স্ক। অধিকাংশ বিয়েতেই যৌতুক হিসেবে দিতে হয়েছে কমপক্ষে একটি গরু। কোন কোন বিয়েতে দু’টো গরুও দিতে হয়েছে। চলতি বাজারে ২০-৩০ হাজার টাকার নিচে সাধারণত কোন গাভী মেলে না। তাই অধিকাংশ পরিবারই যৌতুকের এ চাহিদা মেটাতে গিয়ে ধারদেনায় জড়িয়ে পড়েছে। আবার কয়েকটি বিয়েতে গরু না দিয়ে সে বাবদ নগদ অর্থ দিতে হয়েছে। যৌতুক হিসেবে গরু কেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে চরাঞ্চলের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় দেখা গেছে যে, বেশিরভাগ পাত্রীর পরিবার মনে করে যেহেতু পাত্রপক্ষ বা পাত্র তাদের মতোই হতদরিদ্র, সেহেতু আর কিছু না হোক গাভী পুষে পাত্র তার পরিবারের ভরণপোষণে সমর্থ হবে। মনস্তাত্ত্বিক এ বিষয়টি এক দু’দিনে সৃষ্টি হয়নি। এটি শত বছরের বিষয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটা সময়ে যৌতুকের গরু কেনার জন্য দরিদ্র কৃষকরা গাঁয়ের অবস্থাপন্ন মহাজনদের দ্বারস্থ হয়েছে। মহাজনরা চড়া সুদে টাকা খাটিয়েছে। এখনও সে প্রথাটি আছে। তবে এর পাশে গত কয়েক বছরে যোগ হয়েছে এনজিওদের ক্ষুদ্রঋণ। দরিদ্ররা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে যৌতুকের দায় মেটাচ্ছে। দরিদ্র কৃষকদের মতোই মানতা সম্প্রদায়ের মাঝেও বহুকাল ধরে টিকে আছে যৌতুক প্রথা। তারা জানায়, কয়েকশ’ বছর ধরে পুরুষানুক্রমে এ অঞ্চলে পরিবার-পরিজন নিয়ে নৌকায় দিনযাপন করছে। মাছ ধরা ও বিক্রি তাদের একমাত্র পেশা। এ সম্প্রদায়েও আছে অল্প বয়সে বিয়ের প্রথা। প্রচলন রয়েছে যৌতুকের। শুক্কুর সরদার জানান, বিয়েতে তারা জামাইকে নতুন নৌকা তৈরি করে দেন এ কারণে যাতে নবদম্পতি ওই নৌকায় নতুন জীবন শুরু করতে পারে। সঙ্গে কিছু বড়শিও দেন। যৌতুক হিসেবে নৌকা দিতে গিয়ে বেশিরভাগ পরিবার কৃষকদের মতোই দেনার সাগরে ভেসে বেড়ায়। অনেকেই সারাজীবনে আর সে দেনা শোধ করতে পারে না। মনির সরদার জানান, তারা প্রধানত মাছের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। মহাজনরা শর্তজুড়ে দেন, যতদিনে দেনা শোধ না হবে, ততদিন মহাজনের কাছেই মাছ বিক্রি করতে হবে। যা তাদের পক্ষে আর জীবনে শোধ করা সম্ভব হয় না। ঋণের বোঝা নিয়েই পরপারে পাড়ি জমাতে হয়। Ñশংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×