ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক ব্যাধি

যৌতুক পুরুষের লজ্জা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১৩ আগস্ট ২০১৬

যৌতুক পুরুষের লজ্জা

সামাজিক এই ব্যাধিটি দূর করাই যাচ্ছে না। শরীরের ব্যাধি হলে তা সারানো যায়। ম্যালেরিয়া, বসন্ত, পোলিওসহ অনেক ব্যাধি বিদায় করা গেছে। সমাজের এই ব্যাধি সেই কবে দুষ্টুক্ষত হয়ে বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। যা নিয়ন্ত্রণে কত কিই না করতে হচ্ছে! তবু একেক সময় একেক নামে আবির্ভূত হচ্ছে। বাগধারায় আছে ‘এমন মাছ ছাই দিয়েও ধরা যায় না।’ সামাজিক এই ব্যাধি সহজে ধরা যায় না। ব্যাধি দূর হয় কি করে। এই ব্যাধির নাম ‘যৌতুক’। আমরা বলি যৌতুকের অভিশাপ। প্রশ্ন হলো এই অভিশাপ দিচ্ছে কে! শাপমোচন হচ্ছে না কেন! নানা প্রশ্ন শুধু ঘুরপাক খায়। প্রশ্নের উত্তর মেলে না। পত্রিকার পাতায় মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হয় এই খবর। যার হেডলাইন- যৌতুকের জন্য গৃহবধূ খুন। যৌতুকের জন্য স্বামী শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদের নির্যাতন। যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে নববধূ বা গৃহবধূর আত্মহনন। যৌতুকের কারণে বধূ লাঞ্ছিত। যৌতুক পূরণ করতে না পারায় তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ। খবরগুলো পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়ে আসে। তারপর একসময় নতুন খবরের আড়ালে হারিয়ে যায়। ঘটনার প্রতিকার কি হলো তা আর জানা যায় না। মানব জীবনে দ্বিতীয় পর্বের অভিষেক বিয়ে। অভিষেকের এই বরণ ডালায় কখন যৌতুক নামের দুষ্টুক্ষত প্রবেশ করেছে তার সাল তারিখ নেই। নৃতাত্ত্বিক ধারাতেও এর কোন উল্লেখ নেই। বেশিদূর অতীতে নয় গত শতকের প্রথমের দিকে গ্রামাঞ্চলে জামাইকে সাইকেল ও হাতঘড়ি যৌতুক দেয়ার প্রচলন ছিল। ষাটের দশকে যোগ হয় ট্রানজিস্টর বা রেডিও। বিয়ের কথাবার্তার সময় ঘটকই বিষয়টি উপস্থাপন করে বলেছে ছেলেকে ‘ডিমান্ড’ দিতে হবে। ডিমান্ড এই ইংরেজী শব্দটি বিয়েতে এমনভাবে প্রচলিত হয়ে গেল যে এর আভিধানিক অর্থ ‘দাবি’ আর কেউ বলে না। লোকজন ধরেই নেয় ডিমান্ড মানে যৌতুক। গ্রামের লোকেরা ডিমান্ড কথাটিকে সহজ করে বলে ‘ডিমান’। একটা সময় গ্রামাঞ্চলে জামাইকে বলা হতো ‘দামান্দ’। বয়স্করা বলতো ‘দামান মিয়া’। গত শতকের পঞ্চাশ ষাটের দশকে গ্রামের বিয়েতে বর যৌতুক হিসাবে সাইকেল ঘড়ি বা ট্রানজিস্টর রেডিও পেলে সেই সাইকেলে চেপে গ্রামের পথে ঘুরলে তরুণরা বলত ‘দামান মিয়া চিলিক’। অর্থাৎ জামাইয়ের মনে খুব ফুর্তি। দিনে দিনে যুগের হাওয়ার পরিবর্তনে গত শতকের শেষের দিকে যৌতুকের সাইকেল রেডিও হাত ঘড়ি রিপ্লেস হতে থাকে। মোটরসাইকেল, রঙিন টেলিভিশন, কম্পিউটার, নগদ অর্থ, সোফা সেট, ঘর সাজানো ইত্যাদি। দেশে যখন যৌতুক নিরোধ আইনের প্রয়োগ শুরু হয় তখন মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত বিত্তশালী ও ধনী পরিবারে যৌতুকের জায়গায় বর কনেকে ‘উপহার’ কথাটি চলে আসে। কৌশলে যৌতুক শব্দটি টেম্পার হয়ে যায়। প্রকারান্তরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌতুক উপহারের ছদ্মাবরণে সমাজে প্রবেশ করে। এই দুষ্টুক্ষত এখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে গ্রামীণ জীবনে উপহার কথাটির প্রচলন তেমন নেই। বর সরাসরি নগদ টাকা ও জিনিসপত্র চেয়ে বসে। কনের পরিবার জামাইয়ের দাবি পূরণে অনেক সময় সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। যৌতুক না দিতে পারলে কনের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। শারীরিক, মানসিক নির্যাতন চলতে থাকে। এক সময় শেষ পরিণতি বিয়োগান্তক দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে হয় অবসান। যৌতুকের কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই হয় চাপা পড়ে যায় নয়ত মীমাংসা হয়ে যায়। যৌতুকের কারণে গৃহবধূ খুনের ঘটনা প্রথমে স্পর্শকাতর হয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিছুদিন ফলোআপ করার পর তার আর খোঁজ থাকে না। যৌতুকের ঘটনায় অভিযুক্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাড় পেয়ে যায়। ফের তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসে। আর বিয়ের পর যে মা বাবার কন্যা সন্তান মারা গেল সেই পরিবারের চোখের জল শুকিয়ে যায়। কোন মা বাবার ঘরে যখন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে তখন ফুটফুটে মেয়েকে দেখে পরিবারের কি আনন্দ। একদিন এই মেয়ে বড় হওয়ার পর বিয়ে হয়ে চলে যায় বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি। সেই বাড়ি তখন তার আপন ঘর। স্বামী তার জীবনসঙ্গী। শ্বশুর শাশুড়ি তার বাবা মা। এই আপনজন যখন যৌতুক না পেয়ে নির্যাতন করে, মেরে ফেলে অথবা নির্যাতন সইতে না পেরে বধূ জীবন বিসর্জন দেয়, তার উত্তর কি দিতে পারে এই সমাজ? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সমাজপতিরা নারীর পক্ষে না গিয়ে পুরুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন কোথায় থাকে ‘মানবতা’ নামের শব্দটি! প্রশ্ন ওঠে এই মানবতা কি অপরাধীর পক্ষে! এই বিষয়ে বগুড়ার এ্যাডভোকেট সৈয়দ সুলতান আলম জানান, দেশে যৌতুক প্রতিরোধে যৌতুক নিরোধ আইন আছে। যার ৩ ও ৪ ধারা প্রয়োগে অভিযুক্তের সশ্রম কারাদা-ের বিধান আছে। যৌতুকের কারণে বধূর ওপর শারীরিক নির্যাতন হলে, নির্যাতনে আহত হলে, মারা গেলে ফৌজদারি দ-বিধিতে মামলা দায়ের হয়। বিয়ের সময় কেউ ক্যাশ বা কাইন্ডস উপহার হিসেবে পেলে সেখানে যৌতুক কথাটি উল্লেখ না থাকলে তার কোন মামলা হয় না। যারা চালাক ও বুদ্ধিমান তারা এই সুযোগটিই নিচ্ছে এবং বহাল তবিয়তে তা চালু আছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×