ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণ ক্ষুব্ধ ও হতাশ

খুলনা মহানগরীর হতশ্রী অবস্থা

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৩ আগস্ট ২০১৬

খুলনা মহানগরীর হতশ্রী অবস্থা

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ খুলনা মহানগরীর হতশ্রী অবস্থা। বহু রাস্তা চলাচলের অযোগ্য। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও ফুটপাথ অবৈধ দখলে। বিভিন্ন রাস্তায় যত্রতত্র জমে থাকে ময়লা-আবর্জনা। ড্রেন-নর্দমার বেহাল অবস্থা। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় অধিকাংশ রাস্তা। ভারি বর্ষণ হলে অসংখ্য বাড়িঘরের নিচতলা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢোকে। নিচু এলাকায় সৃষ্টি হয় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও এসব সমস্যা থেকে নগরবাসী পরিত্রাণ পায়নি। বর্তমানে খুলনা মহানগরী যেন গার্বেস সিটিতে (আবর্জনার শহর) পরিণত হয়েছে। জনদুর্ভোগে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, ২০০৮ সালে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ও বর্তমান সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেক এমপি। তাঁর সময়কালে নগরীতে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে বহু ছোট-বড় রাস্তা মেরামত ও পুনঃনির্মাণ করে চলাচল উপযোগী করা হয়। শহীদ হাদিস পার্কে নতুন আঙ্গিকে শহীদ মিনার নির্মাণ ও পার্কের আধুনিকায়নের জন্য তিনি কাজ শুরু করে যান। তাঁর সময়ে সরকার বিভিন্ন অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চার বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট পাঁচ বছর মেয়াদী ‘নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প’টিও তালুকদার আব্দুল খালেকের সময়ে শুরু হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয় ৩৩৫ কোটি টাকা। নগরীর ২২টি খাল, ময়ূর নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে তিনি জোরালো কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি মেয়র পদে হেরে যাওয়ার পর থেকে নগরীর দৃশ্যমান উন্নয়নগুলোর অবস্থাও খারাপ হতে থাকে। বর্তমানে নগরীতে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি ২০০ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ও ৩৩৫ কোটি টাকার নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে মোটা দাগের টাকা ব্যয় করা হলেও নগরবাসী দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। নগরীর রাস্তাঘাট অবর্জনা ও জঞ্জালে ভরা। দুর্গন্ধে পথচলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। নগরীর কেডিএ এ্যাভিনিউ, পিটিআই মোড়, খানজাহান আলী রোডের শান্তিধাম মোড়, মজিদ সরণি থেকে নিউমার্কেট যাওয়ার মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে অবর্জনার স্তূপ জমে। এছাড়াও বিভন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা। ড্রেন-নর্দমা যথাযথভাবে পরিষ্কার না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই প্রায় সকল রাস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ময়লা-অবর্জনা ও দুর্গন্ধময় পানি ঢোকে। নগরীর রাস্তা ও ফুটপাথ অবৈধ দখলে। যশোর রোডের দুই পাশ, ক্লে রোডসহ প্রায় সকল রাস্তা ছোট-বড় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের দখলে। রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী রেখে ভবন নির্মাণ ও বিভিন্ন রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। কেডিএ এ্যাভিনিউ সড়ক, শেখপাড়া মেইন রোড, বাগমারার দিকে যাওয়ার রাস্তা, পূর্ব বানিয়াখামার মসজিদসংলগ্ন রাস্তাসহ বহু রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। কিন্তু যথাসময়ে মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এছাড়া নগরীতে যথেচ্ছভাবে ইজিবাইক চলাচল করায় জনভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাটারিচালিত অবৈধ হাজার হাজার রিক্সা গোটা শহরে চলাচল করছে। ইঞ্জিনচালিত রিক্সার গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অবৈধ এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নানা সময়ে সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে কিছু হয়নি। সম্প্রতি কেসিসির বাজেট ঘোষণাকালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনিছুর রহমান বিশ্বাস নগরবাসীর নানামুখী সমস্যার জন্য সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের প্রশ্নের মুখে পড়েন। এ সময় তিনি বলেন, ময়লা-আবর্জনা অপসারণের জন্য নগরীতে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় স্থানীয় জনগণের বাধার মুখে ওই প্রকল্পের নির্মাণকাজ করা যাচ্ছে না। জমি অধিগ্রহণে চরম বিপত্তি হচ্ছে। স্টেশনগুলো নির্মাণ হলে এ সমস্যা থাকবে না। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবৈধ দখলে থাকা খালগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি কিছু খালের মধ্যে বাঁধ অপসারণ করে কাঠের পুল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই ভাবে রাস্তা-ফুটপাথ থেকে দখলদার উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অন্যান্য সমস্যা সমাধানের বিষয়েও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, হবেÑ এভাবে উত্তর দেন। খুলনার প্রবীণ আইনজীবী সাবেক খুলনা পৌরসভার চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট মোঃ এনায়েত আলী নগরীর বর্তমান বেহাল অবস্থায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, নগরবাসী ট্যাক্স দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। মূলত কনজারভেন্সি, যাতায়াত ব্যবস্থা, সড়ক বাতি, পানীয়জলের ব্যবস্থাÑ এ চারটি মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা জরুরী। পানির ব্যবস্থাপনা এখন ওয়াসার হাতে। কিন্তু কনজারভেন্সি ও সড়ক ব্যবস্থাপনার যে হাল হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ‘আমরা গার্বেজ সিটিতে বসবাস করছি’। বিশৃঙ্খলভাবে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। দুর্গন্ধে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তদারকি নেই। তিনি বলেন, ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতায় বসা এক জিনিস আর মানুষের কল্যাণে কাজ করা আরেক জিনিস। দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভালবেসে কাজ করার অভাব আছে বলে তিনি মনে করেন। নাগরিক নেতা বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, সিটি কর্পোরেশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় জনগণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, রাস্তাঘাট আবর্জনায় ভরা। যেটুকু আবর্জনা অপসারণ করা হয় তা দিনের বেলায়। রাতে অপসারণ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। আগে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর যেসব রাস্তা থেকে পানি অপসারিত হয়ে যেত, ড্রেন-নর্দমা পরিষ্কার না থাকায় এখন অনেক রাস্তায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এ শহরে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ আরও অনেক সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীতাও নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।
×