ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শহুরে শিশুরা প্রকৃতির সুধা থেকে বঞ্চিত

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৩ আগস্ট ২০১৬

শহুরে শিশুরা প্রকৃতির সুধা থেকে বঞ্চিত

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়/ চলছে যে যার কাজেÑ/ কত জনরব কত কলরব/ উঠিছে আকাশমাঝে।’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন পঙ্ক্তি বলে দেয়, প্রতি মানুষই পাখি হয়ে উড়ার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে জন্মায়। জন্মায় আকাশ দেখার সুপ্ত সাধ নিয়ে। চারদেয়ালের বন্দীশালায় শিশুরাও হয়ত এক একটি পাখি। হয়ত তাদেরও ইচ্ছে করে দেয়াল ভেঙ্গে আকাশে উড়ার। এক টুকরো আকাশ ছোঁয়ার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যÑসুপ্ত এ সাধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমানের শিশুরা। বঞ্চিত হচ্ছে সুস্থ বিনোদন থেকেও। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর সামগ্রিক পরিস্থিতিতে শিশুদের সুস্থ বিনোদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহল থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ ‘ভবিষ্যতের প্রয়োজনে চাই শিশুদের সুস্থ বিনোদন, চাই পর্যাপ্ত খোলা মাঠ।’ বাস্তবতায় খোলা মাঠের চাহিদা বাড়লেও সভ্যতার আগ্রাসণে ক্রমশ কমছে তার পরিধি। এমনকি ভবিষ্যতে এর পরিধি আরও কমবে বলেই আশঙ্কা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপর্যাপ্ত খোলা মাঠের ঢেকুর তুলে বসে থাকলেই চলবে না। বিকল্প হিসেবে শিশুটিকে নিয়ে যেতে হবে বাসার ছাদে। বারান্দা কিংবা বেলকুনিতে বসে ফুল-পাখি-লতা-পাতার প্রেমে আকৃষ্ট করে তুলতে হবে শিশুটিকে, যেন ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে প্রকৃতি প্রেমিক। আর যেসব স্থানে খেলার মাঠ রয়েছে শিশুটিকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার চর্চা শুরু করার তাগাদা দিলেন এক মানবাধিকার কর্মী। তার মতে, শিশুর সুস্থ বিনোদনের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকেই তৈরি করতে হবে পরিবেশ। শিশুর সুস্থ বিনোদনের লক্ষ্যে সজাগ থাকতে হবে অভিভাবকদের। রাজধানীর তেজগাঁও পোস্ট অফিস সংলগ্ন কয়েকটি বাসার বারান্দায় প্রায় প্রতিদিনই শিশুদের লক্ষ্য করা যায়। তারা পার্শ্ববর্তী খেলাঘর মাঠের দিকে চেয়ে থাকে। দুই থেকে তিনটি শিশুকে কখনও দেখা গেছে নিজেদের মধ্যে আনন্দ যজ্ঞে মেতে উঠতে। নাখালপড়াতেও একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। বাসা-বাড়ির জালানায় দেখা যায় শিশুদের উন্মুখ চোখ। হয়ত ঘরের বাইরের পরিবেশ উপভোগ করতে চায় তারা। কিংবা দেখতে চায় খোলাকাশ। তবে অধিকাংশই সে সুধাপান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে আর দেখা যায় কতটা? তথ্যমতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ থাকার কথা। বাস্তবতায় ১২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ ওয়ার্ডে খেলার উপযোগী মাঠ রয়েছে মাত্র ৫টি। একইভাবে মাঠের অপর্যাপ্ততা রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও। আর নগরীর পার্কগুলো শিশুদের ব্যবহারের অনপুযোগী। পার্কের নিম্নমানের পরিবেশে অন্য সদস্যদের নিয়ে যেতে অনীহা অনেক অভিভাবকের। অভিভাবকদের ভাষ্য, দিন দিন খেলার মাঠ কমার প্রভাবে মাঠের স্থলে জায়গা করে নিচ্ছে ড্রইংরুম। শিশুরা এলসিডিতে চোখ রেখেই দুনিয়া ঘুরে এখন। টিভি পর্দার রঙিন আলোয় দেখে নেয় দূরের আমাজান, পাহাড়-পর্বত। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউও দেখতে হয় টিভিতেই। জানা গেছে, অধিকাংশ শিশুর আগ্রহ কার্টুনের প্রতিই বেশি। কেউ কেউ কম্পিউটার গেইমে আসক্ত। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশের পরশ ও খেলাধুলার মাধ্যমে ঘটতে পারে সুস্থ মনোবিকাশ। কে এম জামিল আহমেদ ও ড. কানিজ ফাতিমা দম্পতির একমাত্র সন্তান প্রিয়তা। সাড়ে পাঁচ বছরের শিশুটি ঢাকার স্বনামধন্য একটি স্কুলের নার্সারিতে পড়ে। শিশুর বিনোদন নিয়ে কথা হলে জামিল আহমেদ বলেন, ‘নিজেদের কাজকর্ম সেরে আমরা মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হই। তবে বাসার আশপাশেই, মেয়েকে শহীদ মিনার ও টিএসসিতে নিয়ে যাই।’ কথা বলে জানা গেল, কার্টুন দেখার প্রতিই প্রিয়তার আগ্রহ বেশি। এই দম্পত্তি শিশু সন্তানকে নিয়ে বাইরে বের হলেও বহু পরিবারের শিশুরাই প্রাকৃতিক পরিবেশের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত। ফলে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে সুস্থ বিনোদন থেকেও। এ প্রসঙ্গ মানবাধিকার কর্মী এলিন খান জনকণ্ঠকে বলেন, নানা কারণে শিশুর মনোবিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাঠ থাকা সত্ত্বেও শিশুরা সেখানে খেলছে না, আবার শিক্ষকরাও শিশুদের খেলাধুলার প্রতি সেভাবে আগ্রহী করে তুলছে না। যেসব স্কুলে মাঠ রয়েছে সেখানে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের আরও নজর দেয়া উচিত। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বাড়ির পাশে বিশাল মাঠ আছে, কিন্তু শিশুরা খেলার মতো বন্ধু পাচ্ছে না। এজন্য শিশুর উপযোগী সুস্থ পরিবেশ নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। বিদ্যালয় ও বাড়ির পাশে যেসব মাঠ রয়েছে সেখানে শিশুদের নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে হবে। কম্পিউটারে অতিমাত্রায় গেইম খেলার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, মূলত পরিবারিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাবে শিশুর সুস্থ মনোবিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশীদের উচিত নিজের শিশু ছাড়া অন্য শিশুদের প্রতিও নজর রাখা। অতীতে কোন শিশু বিপদগামী হওয়া শঙ্কা দেখা দিলে সমাজের অন্য সদস্যরা সেই শিশুর অভিভাবকে সচেতন করতেন। আর এখন এমনটা হয় না। হলেও মা কিংবা বাবা বলেন, আমার ছেলেটা এমন হতে পারে না! নাÑ আমার মেয়ে এমন নয়! এই ধারণা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। শিশুর সুস্থ বিনোদনের ব্যাপারে বাবা-মাকে স্বশিক্ষিত হতে হবে, তাদের ভাবনার জগতও প্রসারিত হতে হবে। আর পারিবারিক বন্ধন হতে হবে আরও সুদৃঢ়।
×