ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চটকদার বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত অভিভাবক নিজেরাই বাচ্চার মুখে তুলে দিচ্ছেন রোগ প্রতিরোধ হ্রাসের এসব খাবার;###;সঠিক প্রচার না থাকায় আইনকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখাচ্ছেন বিপণনকারীরা

অপুষ্টি ঝুঁকিতে ৬০ লাখ শিশু ॥ কাগজেই সীমাবদ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য আইন

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৩ আগস্ট ২০১৬

অপুষ্টি ঝুঁকিতে ৬০ লাখ শিশু ॥ কাগজেই সীমাবদ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য আইন

আনোয়ার রোজেন ॥ নাজমা ইসলাম একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা। দিনের বেশিরভাগ সময় অফিসে থাকেন, তাই ‘পুষ্টি নিশ্চিত’ করতে আট মাসের ছেলেকে গুঁড়োদুধ খাওয়ান নাজমা। বাচ্চাকে যে ব্র্যান্ডের দুধ তিনি খাওয়ান, সেটির নাম নেসলে ল্যাক্টোজেন-১। এর প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে ‘জন্ম থেকে দেয়া যায়’! প্লাস্টিকের যে ফিডারে করে নাজমার বাচ্চা দুধ খায়, সেটির গায়ে বড় করে লেখা ‘ফর এ্যাঞ্জেল’ (দেবশিশুর জন্য)! এমন চটকদার বিজ্ঞাপন এবং ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে নাজমার মতো অনেক অভিভাবকই তাদের আদরের সন্তানদের মুখে তুলে দিচ্ছেন বিকল্প শিশুখাদ্য। বাড়ছে গুঁড়োদুধ খাওয়া শিশুর সংখ্যা। অথচ এই শিশুরা ভুগছে অপুষ্টিতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমছে তাদের। আর অভিভাবকদের অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে এ সংক্রান্ত আইনকেও ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে শিশুদের জন্য কৌটা বা প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধ, অন্যান্য খাদ্য ও সরঞ্জামাদির প্রলুব্ধকর বিজ্ঞাপন বা প্রচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আইনে। ২০১৩ সালের এ সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, প্যাকেট ও কৌটাজাত পণ্যের গায়ে লেখা থাকতে হবে ‘শিশুর জন্য মায়ের দুধের সমতুল্য বা শ্রেষ্ঠতর কোন খাদ্য নেই।’ আরও লেখা থাকতে হবে ‘এই (কৌটা/প্যাকেট) খাদ্য সম্পূূর্ণ রোগজীবাণুমুক্ত নয়। এটা খেলে শিশুর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি আছে।’ বিকল্প শিশুখাদ্য বিপণন ও ক্রয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে নির্দেশনা। তবে রাজধানীর বিভিন্ন সাধারণ দোকান ও সুপারশপে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বিকল্প শিশুখাদ্য ও সরঞ্জামের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতারা এসব নির্দেশনা মানছেন না। এ বিষয়ক আইন সম্পর্কেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের কেউ তেমন কিছু জানেন না। শিশুস্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর আইনটির প্রচার বিষয়েও নেই কোন সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ। তাই ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য বিক্রয় ও বিপণন’ নামের এ আইন যেন অনেকটা কাগজেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন বছর হয়ে গেলেও বিকল্প শিশুখাদ্য আইনের তেমন প্রচার নেই। তাই না জেনেই দোকানে এসব গুঁড়োদুধ ও অন্যান্য খাদ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন সাধারণ দোকানীরা। একই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সুপারশপে। শিশুর মা-বাবাসহ অভিভাবকরাও মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে এসব খাদ্যের বিষয়ে সচেতন নন। চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, জন্মের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ পুষ্টিকর খাদ্য। বিকল্প হিসেবে গুঁড়োদুধ শিশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ দুধ নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শিশু ঘন ঘন অসুস্থ হয়, শারীরিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না। বাজারে সাধারণত দুই ধরনের বিকল্প শিশুখাদ্য পাওয়া যায়। একটি শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস, এক বছর বা দুই বছর বয়সী শিশুদের জন্য ‘বিশেষ ফর্মুলায়’ তৈরি গুঁড়োদুধ। অন্যটি ছয় মাসের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার হিসেবে দেয়া ‘ফর্মুলা ফুড’। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ হেলাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এমনিতে যে কোন খাদ্যে পুষ্টিগুণ থাকলে তা মানসিক বিকাশে সাহায্য করবে। কিন্তু দুই বছর পর্যন্ত বাচ্চার বিকাশের জন্য বিকল্প শিশুখাদ্যের কোন গুরুত্ব নেই। এজন্য মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। মায়ের বুকের দুধে যে পুষ্টি আছে, এর কাছাকাছি পুষ্টি অন্য কোন খাবারে নেই। তবে মায়ের অসুস্থতা বা মা এমন কোন ওষুধ খাচ্ছেন, যাতে শিশুকে বুকের দুধ দেয়া যাবে না- এমন ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। জন্মের পর শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করার উদ্যোগ রয়েছে সারাবিশ্বে। ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মায়ের দুধের বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা তৈরি করে, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত। সেই নীতিমালার আলোকে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর আইনটি সংশোধন করা হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিকল্প খাদ্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে আইনে। সংশোধিত আইনে শাস্তি হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে জরিমানার অর্থ বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা ও কারাদ-ের সময় বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়েছে। একই ধরনের অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে জরিমানা ও কারাদ- উভয়ই দ্বিগুণ হারে প্রয়োগের বিধানও আইনে রয়েছে। তবুও রাজধানী ঢাকার সুপারশপগুলো থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন উপজেলা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে অবাধেই বিক্রি হচ্ছে নানা ব্র্যান্ডের মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য ও দুধ। বুধবার ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর পান্থপথ এবং ধানম-ি এলাকার ছয়টি অভিজাত সুপারশপের ‘বেবিফুড কর্নার’ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আইন অমান্য করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিকল্প শিশুখাদ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানগুলো। বিক্রেতারা যেমন আইন মানছেন না, তেমনি এসব খাদ্যপণ্যের বাজারজাতকারীরাও প্যাকেট/ কৌটার গায়ে আইনে উল্লিখিত নির্দেশনাবলী লেখার নিয়ম সঠিকভাবে মানছেন না। নেসলে, ডানো, ডিপ্লোমা, ফ্রেশ, সুপারফ্রেশ, বায়োমিল, নিডো ইত্যাদি ব্র্যান্ডের প্যাকেট বা কৌটার কোনটিতেই ‘এই (কৌটা/প্যাকেট) খাদ্য সম্পূূর্ণ রোগজীবাণুমুক্ত নয়। এটা খেলে শিশুর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি আছে’Ñ নির্দেশনাটির উল্লেখ নেই। কয়েকটি ব্র্যান্ডের প্যাকেটে ‘শিশুর জন্য মায়ের দুধের সমতুল্য বা শ্রেষ্ঠতর কোন খাদ্য নেই’Ñ এই কথাটিরও উল্লেখ নেই। জিজ্ঞেস করলে এসব সুপারশপের বিক্রয়কর্মীরা এ সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে জানেন না বলে এই প্রতিবেদককে জানান। বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশন (বিবিএফ) নিজস্ব উদ্যোগ এবং সরকারের সহযোগিতা নিয়ে বিকল্প শিশুখাদ্যের বিপণন কার্যক্রম তদারক করে থাকে। বিবিএফের চেয়ারপার্সন ডাঃ এস কে রায় জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ শিশু জন্মায়। তাই বছর ঘুরতেই দুই বছর বয়সী বাচ্চার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬০ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক শিশুর প্রত্যেককে দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের অভিভাবকদেরই এ বিষয়ে অসচেতনতা রয়েছে। তাছাড়া আইনের প্রচার ও সচেতনতা কার্যক্রম লোকবল ও অর্থ বরাদ্দের ওপর নির্ভর করে। সরকার বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ সংক্রান্ত প্রচার বাড়ানোর জন্য বিবিএফ এবং জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছর মেয়াদী একটি কর্মকৌশল তৈরি করছে বলে জানান তিনি। আইনের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে বিকল্প শিশুখাদ্য আইনের ৮(১) ধারায় একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নয় সদস্যের এই কমিটির চেয়ারম্যান। জানা গেছে, কমিটি গঠনের পর গত তিন বছরে মিটিং হয়েছে মাত্র চারটি। আইন অনুযায়ী এই কমিটির কাজে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সাচিবিক ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করার কথা। এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য সচিব ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডাঃ এবিএম মুজহারুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও নজরদারি করা সম্ভব নয়। এজন্য যত লোকবল দরকার তা নেই। তবুও সক্ষমতার সর্বোচ্চটা ব্যবহারের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। সরকারী হাসপাতালের নার্স এবং চিকিৎসকদের এ বিষয়ে পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে মিল রেখে টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সচেতনতা তৈরির জন্য সারাদেশে ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ আয়োজন করা হয়েছে ব্যাপক পরিসরে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে গণমাধ্যমের আরও বেশি ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
×