ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আর্টিজানের আরেক মাস্টারমাইন্ড ‘মারজান’ শনাক্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ আগস্ট ২০১৬

আর্টিজানের আরেক মাস্টারমাইন্ড ‘মারজান’ শনাক্ত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তুরাঁয় জঙ্গী হামলার আরও এক মাস্টারমাইন্ড শনাক্ত হয়েছে। ‘মারজান’ নামের ওই মাস্টারমাইন্ডের প্রকৃত নাম-পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। আর্টিজানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ছবি মারজানই বিশ্বব্যাপী বিশেষ এ্যাপসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। কল্যাণপুরের জাহাজবাড়িতে বসেই গুলশান হামলা মনিটরিং করেছিল মারজান। এছাড়া গুলশান ও শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলার অপর দুই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত ও ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত মোস্ট ওয়ান্টেড সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী এবং সদ্য প্রকাশ পাওয়া আরেক মাস্টারমাইন্ড মারজান ঢাকাতেই রয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। তারা গোয়েন্দা জালে রয়েছে বলে অসমর্থিত বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও দায়িত্বশীল কোন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। ঢাকা থেকে নতুন জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের আরও পাঁচ সদস্য গ্রেফতারের পর এক সংবাদ সম্মেলনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্যই জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। গ্রেফতারকৃত নতুন জেএমবি সদস্যদের ছয় দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। এছাড়া ঢাকায় পৃথক আরেকটি অভিযানে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন)। বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে নতুন জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। তারা হচ্ছে, আতিকুর রহমান ওরফে আইটি আতিক, মোঃ আব্দুল করিম বুলবুল ওরফে ডাঃ বুলবুল, মোঃ আবুল কালাম আজাদ, মোঃ মতিউর রহমান ও শাহিনুর রহমান হিমেল ওরফে তারেক। তাদের কাছ থেকে বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত ২৫ টি ডেটোনেটর ও ৮৭৫ গ্রাম জেল বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। শুক্রবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এবং পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম জানান, জেএমবির আমির মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরমধ্যে একটি গ্রুপ আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেনি। তারা সব সময়ই নিষ্ক্রিয় ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদের উত্থানের পর নিষ্ক্রিয় থাকা জেএমবির গ্রুপটি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় গত একবছর ধরে জেএমবির নিষ্ক্রিয় গ্রুপটি নতুন জেএমবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। প্রায় এক বছর ধরে নতুন জেএমবি সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ বিদেশীসহ ২২ জনকে হত্যা করে জঙ্গীরা। পরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা অপারেশন থান্ডারবোল্টের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেখান থেকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয় দেশী-বিদেশীসহ ১৩ জন। নিহত হয় ছয় জঙ্গী। গুলশান হামলার পর পরই গত ৭ জুলাই দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া মাঠে হামলা করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে জঙ্গীরা। সেখানে জঙ্গী হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় নিহত চার পুলিশ সদস্যকে পুলিশ ও মধুমতি ব্যাংকের তরফ থেকে ৯০ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। নিহতদের মধ্যে রবিউল হককে সরকার বিশেষ ব্যবস্থায় পেনশনের সুবিধা দেয়। শোলাকিয়ায় হামলার চেষ্টাকালে গ্রেফতার হয় শফিউল নামের এক জঙ্গী। ঘটনা দুটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। দুটি আলোচিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে তদন্তে নতুন জেএমবির নাম আসে। দাওলাতুল ইসলাম নামে নতুন জেএমবির নাম প্রকাশ পায়। গত ৯ আগস্ট ঢাকা থেকে র‌্যাব নতুন জেএমবি দাওলাতুল ইসলামের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছিল বলে র‌্যাব আনুষ্ঠানিকভাবেই জানায়। র‌্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত সবাই আত্মঘাতী। কল্যাণপুর থেকে গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতার সবাই আত্মঘাতী হামলাকারী। তারা সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। তাদের উত্তরবঙ্গ থেকে বড় ধরনের হামলা চালাতে ঢাকায় আনা হয়েছিল। তারা ঢাকার একটি বাসায় উঠে বড় ধরনের নাশকতার ছক কষার পরিকল্পনা করছিল। অভিযানকালে চারজন পালিয়ে যায়। গ্রেফতারদের তথ্য মোতাবেক তাদের নাম নান্নু, সজীব, ইমরান ও জিন্স। তবে এসব নাম তাদের সাংগঠনিক ছদ্মনাম না প্রকৃত নাম, তা জানা যায়নি। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের জাহাজ বিন্ডিংয়ে পুলিশের অভিযানে নিহত নয় জঙ্গী, আহত অবস্থায় গ্রেফতারকৃত রাকিবুল হাসান রিগ্যান ও পলাতক ইকবাল নতুন জেএমবির সদস্য। নয় জঙ্গী নিহত এবং একজন গ্রেফতারের পর ঢাকায় নতুন জেএমবির তৎপরতা কমে যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করে সাংগঠনিক কর্মকা- বাড়ানোর পাশাপাশি বড় ধরনের নাশকতা চালাতে গ্রেফতারদের ঢাকায় আনা হয়েছিল। গ্রেফতারকৃতরা কয়েক মাস আগে কল্যাণপুরের ওই বাড়ি ছাড়ে। তারা কয়েক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় বলে জানায়। কল্যাণপুর থেকে গ্রেফতারদের কাছ থেকে কল্যাণপুরে নিহত নয় জঙ্গী, পলাতক ইকবাল ও আহত অবস্থায় গ্রেফতার রাকিবুল হাসান রিগ্যান সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক নানা ঘটনার মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া ও তামিম আহমেদ চৌধুরী ঢাকায় থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, সেনাবাহিনীতে ক্যুর চেষ্টার দায়ে ২০১২ সালে মেজর জিয়াকে চাকরিচ্যুত করে সেনাবাহিনী। সূত্র বলছে, সম্প্রতি ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ মুক্তমনা মানুষকে হত্যার নেপথ্যে থেকে কাজ করছে মেজর জিয়া। সে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সামরিক শাখার প্রধান। বর্তমানে আনসার আল ইসলামের নামে কাজ করছে। আর তামিম আহমেদ চৌধুরী আইএসের বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছে। সাম্প্রতিক জঙ্গী কর্মকা-ের হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে গত ২ আগস্ট পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে প্রত্যেককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা করে ৪০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। মনিরুল ইসলাম বলছেন, মেজর জিয়া ও তামিম চৌধুরী ছাড়াও গুলশান হত্যাকা-ের আরও এক মাস্টারমাইন্ড সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক সেই মাস্টারমাইন্ডের নাম মারজান। তবে এটি তার প্রকৃত নাম না সাংগঠনিক ছদ্মনাম তা জানার চেষ্টা চলছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক মারজান খুবই চতুর, প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী এবং উচ্চ শিক্ষিত। গুলশান হামলার পর মারজানের কাছে হামলাকারী জঙ্গীরা বিশেষ এ্যাপসের মাধ্যমে ছবি পাঠায়। মারজান হামলার সেই ছবিগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়। জেএমবির প্রচার শাখার দায়িত্ব পালন করে মারজান। শুধু তাই নয়, গুলশান হামলাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে এ্যাপসের মাধ্যমে মারজান কথাও বলেছে। হামলাকারীরা হলি আর্টিজানের ভেতরের নৃশংস ছবি পাঠানোর জন্য জঙ্গীদের প্রশংসাও করে মারজান। তার প্রশংসা পেয়ে জঙ্গীরাও খুশী হয়। সে নতুন জেএমবি সদস্যদের কাউন্সেলিং করানোর দায়িত্ব পালনে জড়িত। মারজানও ঢাকাতেই থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাস্টারমাইন্ডসহ সাম্প্রতিক জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সূত্র বলছে, হলি আর্টিজানে হামলার রাতে জঙ্গীরা উইকার এ্যাপ নামে একটি বিশেষ এ্যাপসের মাধ্যমে বাইরে যোগাযোগ করে ও ছবি পাঠায়। হাসনাত করিম তার মোবাইল থেকে এই এ্যাপসটি ডাউনলোড করে জঙ্গীদের দিয়েছিলেন। করেছিলেন মারজান। কল্যাণপুর বসে মারজান গুলশান হামলা মনিটরিং করে। গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে পুলিশী অভিযানকালে মারজান সেখানে ছিল না। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) যুগপৎ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকার অধিকাংশই এসেছিল বিদেশ থেকে। বাংলাদেশের কয়েকটি এনজিওর মাধ্যমে বিদেশ থেকে সেই টাকা এসেছিল। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশী ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমে জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ) এবং পরবর্তীতে জেএমবিকে (জামা’তুল মুজাহিদীন) নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। নিষিদ্ধ হওয়ার পর জঙ্গী সংগঠনটির আমির নিযুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর। সাইদুর রহমান জেএমবির আমির নিযুক্ত হওয়ার আগে ছাত্র শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি ও জামায়াতের মৌলভীবাজার জেলা শাখার আমির ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য থাকা অবস্থায় ২০০৬ সালে তিনি জেএমবির আমির হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পিবিআইয়ের ঢাকা মহানগর শাখার একটি দল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে হুজির নারায়ণগঞ্জ শাখার কমান্ডার মোঃ রিদোয়ান (৩৪) ও সদস্য জাফর আহমেদকে (৩৫) গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই, সরকারবিরোধী লিফলেট, হুজির প্রচারপত্র উদ্ধার করা হয়।
×