ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

প্রাণঘাতী তামাক চাষ নয়, চা বাগান তৈরিতে ঝুঁকছেন কৃষক

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ আগস্ট ২০১৬

প্রাণঘাতী তামাক চাষ নয়, চা বাগান তৈরিতে ঝুঁকছেন কৃষক

তাহমিন হক ববী ॥ চা বাগানের নাম নিলেই মনে হয় সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে উঁচু-নিচু সবুজে ঘেরা টিলা আর পাহাড়ের গাঁয়ে সারি সারি চা গাছ। কিন্তু সমতল ভূমিতেও যে চায়ের চাষ বা চা বাগান হতে পারে তা উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়ের (তেঁতুলিয়া) পর এবার নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় সমতল ভূমিতে চা চাষে সাফল্য ফুটে উঠেছে। তামাক চাষের পরিবর্তে নীলফামারীর চাষীরা এবার অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান তৈরি করেছে। সমতল ভূমিতে সুন্দর সবুজ চায়ের বাগান আপনাকে ক্রমেই মোহিত করে তুলবে। সন্ধ্যার পর এসব চা বাগানে নেমে আসে স্বর্গীয় সৌন্দর্য। আকাশে যখন রূপালী চাঁদ ওঠে তখন মনে হয় আপনি যেন ভেসে বেড়াচ্ছেন নীলপরীর দেশে। চা গাছের সবুজ পাতায় যখন চাঁদের আলো আছড়ে পড়ে তখন সৃষ্টি হয় অদ্ভুত এক মায়াবী পরিবেশ। জোনাকিরাও তখন ওড়াউড়ি করে বাগান সাজায় আপন মনে। মনে হয় এ যেন মর্তের বাইরে ভিন্ন কোন জগৎ। সত্যিই এ যেন এক রূপকথার দেশ। ইতিহাস থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে চায়ের চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালে। সিলেটে নয়, চট্টগ্রামের ক্লাব প্রাঙ্গণে। সিলেটে উৎপাদন শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। আর পঞ্চগড়ে ১৯৯৮ সালে, প্রায় ১৫০ বছর পর। এবার ২০১৫ সালে চা চাষ শুরু হয়েছে নীলফামারীতে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জেলার কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পতিত ও তামাক চাষের জমিগুলো এখন পরিণত হয়েছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির ফসল চা চাষের জমিতে। তামাক চাষখ্যাত সমতল ভূমিতেও চা চাষ শুরু হওয়ায় কৃষকদের মাঝে চা চাষে যেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পড়েছে ব্যাপক সাড়া। বর্তমানে এই উপজেলার ১১৭ একর জমিতে চা বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এক বছর ৬ মাসে চা পাতা তোলা, উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করা হয়, যা সনাতন পদ্ধতিতে চা প্রক্রিয়াজাত করে ‘কাইজেন টি’ নামে বাজারজাত শুরু হয়েছে। ফলে খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। এদিকে তামাক চাষীদের চা চাষের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণ করে চা চাষ ব্যাপকহারে করে এ উপজেলাকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা যাবে বলে অনেকের ধারণা। কিশোরীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বর প্রায় ২২ একর জমি নিয়ে অবস্থিত। পতিত জমিগুলো ব্যবহারের লক্ষ্যে পঞ্চগড়ে চা বোর্ডের কর্মরত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথমে মাটি পরীক্ষা করে দেখা যায় এ এলাকার মাটি চা চাষের উপযোগী। ভিক্ষুকমুক্ত এই উপজেলার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উপজেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে এক বিঘা জমিতে প্রায় ২ হাজার চা চারা রোপণ করে চা চাষ করে আশাতিত ফল পাওয়া যায়। এর সফলতা ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপকহরে চা বাগান সৃষ্টি হতে থাকে। বর্তমানে উপজেলার ১১৭ একর জমিতে চা বাগান হয়েছে। এর ব্যাপকতা আরও ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে উপজেলা পরিষদ চত্বর, সিনহা চত্বর, কেশবা গুচ্ছগ্রাম এলাকা, মাগুড়া তহশিল অফিস এলাকায় বিষবৃক্ষ তামাক চাষের পরিবর্তে চা চাষের দিকে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেভাবে শুরু ॥ জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ না থাকায় উপজেলার পুনর্বাসিত ভিক্ষুক-দরিদ্র মানুষজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন সরকারী দফতর, ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে কি করে খাবে এ কথা ব্যক্ত করতেন। এসব ব্যক্তির কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ২০১৫ সালে উপজেলা পরিষদের সিদ্ধান্তেও জেলা প্রশাসনের পরামর্শে পরিষদের পতিত জমিতে চা চাষ শুরু করে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ॥ চা বাগানগুলো পুনর্বাসিত-দরিদ্রদের কর্মসংস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ এসে যদি বলত কি করে খাবো তাকে ঘণ্টা প্রতি ২০ টাকা করে শ্রমের মূল্য দিয়ে বাগানে কাজ করানো জন্য লাগানো হয়। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ১৬০ টাকা করে পারিশ্রমিক পায়। চা বাগানের ফলে অলস হাতগুলো কর্মের হাতে পরিণত হয়েছে। ফলে ওই পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সৃজিত বাগানগুলোতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নের প্রতীকী ফসল ॥ চা অভিজাত ও দীর্ঘজীবী ফসল। চা চারা একবার রোপণ করলে আনুমানিক ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত এর উৎপাদন ক্ষমতা থাকে। বাণিজ্যিকভাবে কমপক্ষে ৫০ বছর পাতা উত্তোলন করা যায়। চা চারা রোপণের ৬ মাস পর থেকে প্রতি বছরে একরে আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকার পাতা উত্তোলন করা হচ্ছে। খরচ বাদে বছর এক লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা লাভ হয়। তামাকের পরিবর্তে চা চাষ ॥ বিষাক্ত তামাক চাষে কুখ্যাতি অর্জনকারী এলাকা নীলফামারীর কিশোরীগঞ্জ উপজেলা। তামাক চাষের ফলে এলাকার ধানসহ বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি চলে যাচ্ছে তামাক চাষের কবলে। এতে জমি হারাচ্ছে উর্বরতা। তামাক চাষের ফলে তামাক চাষী, পরিবারের সদস্য ও পার্শ্ববর্তী লোকজনের স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রকম রোগে ভুগতে থাকে। তামাক চাষ ক্ষতিকারক বুঝতে পেরে কৃষকরা তামাক চাষের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব চা চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। এ ফসল এ এলাকার জন্য তামাকের বিকল্প ফসলে রূপান্তন হবে এমটাই ভাবছে অনেকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ॥ এখানে চা তৈরির ফ্যাক্টরি গড়ে না উঠায় সনাতন পদ্ধতিতে চা চাষ শুরু হয়। কাঁচা পাতা উত্তোলন করে প্রথমে বাছাই করা হয়। এর কাঁচা পাতা ঢেঁকি দিয়ে পিসিয়ে তা ভাজা হয়। ভাজা চা পাতার গুঁড়াগুলো পরিষ্কার করে চা তৈরি করা হয়।
×