ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেউ কেউ বলছে আগের তুলনায় এটা জান্নাত সমতুল্য

কেমন কাটছে বন্দীদের জীবন ॥ কেরানীগঞ্জে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ আগস্ট ২০১৬

কেমন কাটছে বন্দীদের জীবন ॥ কেরানীগঞ্জে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার

মশিউর রহমান খান ॥ সুবিধা-অসুবিধা নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোড থেকে কেরানীগঞ্জে নতুন কারাগারে বন্দী স্থানান্তরের সপ্তাহখানেক পর সরেজমিন পরিদর্শন, কারা কর্তৃপক্ষ এবং বন্দীদের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এই সুবিধা-অসুবিধার চিত্র। পুরনো কারাগার থেকে দ্বিগুণের বেশি পরিসরে আট হাজার কারাবন্দী উপভোগ করছে মুক্ত বাতাস ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। অধূমপায়ী, বৃদ্ধ ও কিশোরদের জন্য রয়েছে পৃথক থাকার ব্যবস্থা। গোসল ও খাবারের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা এবং দিন-রাত সব সময়ের জন্য টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা। পাশাপাশি নতুন জায়গার কারণে বেশ কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খাবার সরবরাহে বিলম্ব, স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতে সমস্যা, বৈদ্যুতিক সমস্যা, বন্দী রুগীদের চিকিৎসা গ্রহণে জটিলতা, বিনোদন সামগ্রীর অভাব। কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, এসব সমস্যা সাময়িক। নতুন জায়গায় স্থানান্তরের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। এগুলো খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। এই কারাগারে বন্দীরা থাকবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। আয়তন ও বন্দী ধারণ ক্ষমতায় দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এ কারাগারটি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন কারাগার হিসেবেই তৈরি করেছে বর্তমান সরকার। বন্দীদের অধিক সুবিধা প্রদানের জন্য বিশাল এ কারাগারটি তৈরিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারা কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সময় নানা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের তুলনায় আয়তনসহ প্রায় দিক দিয়েই দ্বিগুণÑ কোন কোন দিক দিয়ে তিনগুণ বেশি সুবিধাসম্পন্ন করেই তৈরি করা হয়েছে কেরানীগঞ্জের এ নতুন কারাগারটি। কারা কর্তৃপক্ষ নতুন কারাগারটিতে বন্দীর সুবিধার্থে দেশে প্রথমবারের মতো কিছু নতুন সুবিধা প্রদান কার্যক্রম চালু করেছে। যা ব্যতিক্রমী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে কেরানীগঞ্জের এ কারাগারটিকে। গণপূর্ত অধিদফতরের সহায়তায় নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা গেলে নতুন কারাগারটিতে পুরনো কারাগারের তুলনায় বন্দীদের তিনগুণ বেশি সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হবে বলে কারা সূত্র নিশ্চিত করেছে। উল্লেখ্য, গত ২৯ জুলাই প্রায় সাড়ে ৬ হাজারের বেশি বন্দীকে নির্বিঘেœ কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে একদিনে নতুন কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সঙ্গে একদিনে এত বন্দী স্থানান্তর এই প্রথম। কারা সূত্র জানায়, কারাগারটিতে বন্দী স্থানান্তরের পর প্রথমদিকে কিছু সমস্যা পোহাতে হয় কারাবন্দীদের। কারা মহাপরিদর্শকের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ ও কর্তৃপক্ষের সকলের সহযোগিতায় পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রথম কয়েকদিন বিভিন্ন সমস্যার কারণ কিছু বন্দী অন্য কারাগারে স্থানান্তর হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও এখন তারাই সন্তোষ প্রকাশ করছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে সাজা ভোগ করা পুরনো কয়েদিদের মতে, বর্তমানে এটিই হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আধুনিক কারাগার। তাদের মতে, কারাগারের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে থাকার স্থান ও টয়লেটসহ গোসলের সমস্যা। যা এই কারাগারে একদমই নেই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন এ কারাগারের করতোয়া নামের একটি ভবনে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বৃদ্ধ, কিশোর ও অধূমপায়ী বন্দীদের জন্য পৃথক সেল গঠন করা হয়েছে। আমরা চাই দেশের বৃহত্তম এ কারাগারটি শুধু কারাগারই নয়, এটি হোক সংশোধনাগার। তাছাড়া সকল কারাবন্দীই আমাদের কাছে মৌলিক অধিকার ভোগ করার দাবি রাখে। বৃদ্ধ ও কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক দিক বিবেচনা করে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ধূমপায়ী বন্দী থেকে অধূমপায়ী বন্দীদের আলাদা রাখার ব্যবস্থার অংশ হিসেবেই তাদের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে অধূমপায়ী কোন বন্দী ইচ্ছা করলেই নির্ধারিত ভবনের নির্দিষ্ট এসব সেলে থাকতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারবেন। যার ব্যবস্থা করবে কারা প্রশাসন। এ ভবনের নির্দিষ্ট কক্ষে এসব বন্দীকে রাখা হচ্ছে। ভবনটির ২য় তলায় বয়সের ভারে ন্যুব্জ বা পঞ্চাষোর্ধ বন্দীদের রাখা হয়েছে। ৩য় তলায় অধূমপায়ী বন্দীদের রাখা হয়েছে। ৪র্থ তলায় সাধারণ বন্দী আর ৫ম ও ষষ্ঠ তলায় কিশোর বা যুবক বন্দীদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে একটি ভবনে এ ব্যবস্থা চালু করলেও পরবর্তীতে প্রয়োজনে অন্যান্য ভবনেও এ ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এতে অনেক বন্দীর সংশ্লিষ্ট এসব সুবিধা নিশ্চিত হবে। আগে ছোট, বড়, বৃদ্ধ বা যুবক সকল শ্রেণীর বন্দীকে এক কক্ষে এক সঙ্গে রাখা হতো। বন্দীর জন্য আলাদা আলাদা কক্ষের কোন ব্যবস্থা রাখা হতো না। এছাড়া নতুন কারাগারটিতে বন্দীদের বিনোদনের জন্য কারাভ্যন্তরের কেস টেবিলের সামনে বিশাল একটি সাউন্ড বক্স রাখা হয়েছে। সেখানে বন্দীরা ইচ্ছেমতো তাদের পছন্দের গান শুনতে পারছেন। জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কারাগারের প্যারামিটার ওয়ালের বাইরের নিরাপত্তা দেয়ালটি নির্মাণের পর কারাভ্যন্তরে বন্দীদের নিয়ে নিয়মিত গানবাজনার প্রতিযোগিতা আয়োজনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া এ কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের প্রতিটি বন্দীর সঙ্গে সুন্দর আচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কারাগার থেকে বের হয়ে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন গঠনের জন্য নিয়মিত মোটিভেশন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। মূলত এ কারাগারটিকে আমরা একটি মডেল কারাগার হিসেবে গড়ার চেষ্টা করছি। কারাগারকে শুধু শাস্তি প্রদানের স্থানই নয়, বন্দী সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এ লক্ষ্যেই নতুন কারাগারে বিশেষ কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। জেল সুপার বলেন, স্বাভাবিকভাবে নতুন কোন স্থানে এলে সবাইকে যেমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তেমনি সমস্যায় আমাদেরও পড়তে হয়েছে। আস্তে আস্তে সকল সমস্যাই কেটে যাবে। এজন্য আমরা নিয়মিত উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি ও তাদের দেয়া বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছি। ফলে সমস্যাগুলো অতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কারাগার স্থানান্তরের পর এ পর্যন্ত কারা মহাপরিদর্শক ৪ বার নতুন এ কারাগারটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করায় তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট সকল সঙ্কটের সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। আরও কিছু সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। জানা গেছে, বন্দী স্থানান্তরের পর প্রথম ৫ দিন বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসা স্বজনরা সাক্ষাত কক্ষে গেলেও কেউ কোন কথা বলতে পারেননি। দুই পাশের লোহার গ্রিলের মাঝে ছোট ছোট ছিদ্রের একটি কাঁচের দেয়াল তুলে দেয়ায় বন্দী বা স্বজনদের উভয় প্রান্তের কেউ কোন কথা শুনতে পারেননি। যার ফলে অনেক বন্দী কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন কারাগারের সমস্যা সরেজমিনে পরিদর্শনের পর বন্দী ও স্বজনদের সাক্ষাতের সুবিধার্থে একদিনের মধ্যেই মাঝের এ কাঁচের দেয়াল সরিয়ে নিতে গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্দেশ দেন। এরপর গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা এ কাঁচের দেয়ালটি তুলে নেন। এর ফলে বর্তমানে কারাবন্দীর সঙ্গে সাক্ষাত প্রার্থী স্বজনরা অনায়াসে কথা বলতে পারছেন। তবে এ কারাগারটির আয়তন ও বন্দীর তুলনায় সাক্ষাত কক্ষটি অত্যন্ত কম ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। নতুন আরও কয়েকটি ভবন তৈরি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কারাসূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন নতুন কারাগারে স্থানান্তরের পর রান্নার চুলার সমস্যা থাকায় বন্দীদের কারা কর্তৃপক্ষ অনেক কষ্টে রাত দশটার দিকে রাতের খাবার দিতে সক্ষম হয়। এ সময় অনেক কারাবন্দী রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। ২শ’ ৫০টি পাতিলে করে গ্যাস দিয়ে রান্না করার জন্য এ কারাগারে ৫০টি চুলা তৈরি করা হয়। কিন্তু এ কারাগারে গ্যাস সংযোগ না থাকায় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কাঠের লাকড়ি দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেন। ফলে বন্দীদের সকালের নাস্তা সকাল ৭টার পরিবর্তে ১০টা বেজে যায়, দুপুরের খাবার বিকেল ৫টায় এবং রাতের খাবার পৌঁছাতে রাত ৯টা থেকে ১০ পর্যন্ত বেজে যায়। এতে বন্দীদের সর্বশেষ সংখ্যা গণনার পর তালাবদ্ধ (লকআপ) করতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান কল্পে কারা মহাপরিদর্শক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গ্যাস দিয়ে রান্নার জন্য তৈরি বন্ধু চুলার ব্যবহার সাময়িকভাবে বন্ধ করে কাঠের লাকড়ি দিয়ে রান্নার চুলা তৈরির নির্দেশ দেন। এ জন্য তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে লাকড়ির চুলা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ১০ কয়েদিকে যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকায় চুলা তৈরির জন্য নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এসব কয়েদি এসে পুরনো চুলার পরিবর্তে খোলা স্থানে লাকড়ির চুলা তৈরি করেন। বর্তমানে নতুন এসব চুলায় বন্দীদের রান্নার কাজ শুরু করার ফলে সঠিক সময়েই বন্দীরা খাবার গ্রহণ করতে পারছেন। প্রাথমিকভাবে রান্নার সমস্যা বর্তমানে আর নেই। পরবর্তীতে গ্যাস সংযোগ পাওয়া গেলে পুনরায় আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি এসব বন্ধু চুলায় রান্নার কাজ শুরু করা হবে। বর্তমানে নিয়মিত তিন বেলায় গড়ে মোট ২১ হাজার বন্দীর জন্য রান্না করতে হচ্ছে। যা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপারও বটে। কাঠের চুলার জন্য শত শত মন কাঠের লাকড়ির প্রয়োজন হচ্ছে। কারাসূত্র জানায়, নতুন এ কারাগারটিতে আটক বন্দীদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তৈরি করা এমআই ইউনিট নামে ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে। চাহিদার তুলনায় এ ইউনিটে তেমন বন্দীর চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব নয় বিধায় কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারের কিশোর বন্দীদের জন্য তৈরি করা সুরমা ভবনকে প্রাথমিকভাবে কারা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১শ’ ৭২ শয্যার কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ও নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের এ ভবনে রেখেই চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। বন্দীর সুচিকিৎসার সুবিধার্থে বর্তমানে এমআই ইউনিটটিকে আউটডোর রোগীদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বন্দীর ওষুধ সঙ্কট সমস্যার সমাধানে প্রাথমিকভাবে একটি কক্ষকে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জানা গেছে, প্রথম কয়েকদিন প্রতিটি ভবনের জন্য নির্ধারিত পানির ট্যাঙ্কগুলো পরিমাণমতো পানি ধারণ করতে না পারায় পানি উপচে পড়ত। ফলে পানি না থাকায় বন্দীদের গোসল করতে সমস্যার সৃষ্টি হতো। বর্তমানে এসব পানির ট্যাঙ্কগুলো সংস্কার করা হয়েছে। পানির সঙ্কট মেটানোর ফলে রান্না ও গোসলের সঙ্কট প্রাথমিকভাবে সমাধান করা হয়েছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বন্দীদের গোসলের জন্য প্রতিটি ভবনের সঙ্গে অতিরিক্ত কমপক্ষে আরও একটি করে চৌবাচ্চা নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে গণপূর্ত বিভাগের কাছে মতামত দিয়েছেন। কারা কর্তৃপক্ষ এজন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে। কারাভ্যন্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণ গণশৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে দিনের বেলায় বন্দীদের ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ বছরের সমস্যা হিসেবে শৌচাগার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। চারদিকে ফাঁকা স্থান থাকায় কারাবন্দীরা অনায়াসে একস্থান হতে অন্য স্থানে হাঁটাচলা করতে পারছেন। ফলে পুরনো কারাগারের হাঁটাচলার স্থানের সমস্যা দূর হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে খাবার পানির জন্য পানির কল বসানো হয়েছে। পানি সমস্যার সমাধানে কারাভ্যন্তরে অতিরিক্ত পানির পাম্প বসানো হয়েছে। সশ্রম কারাবন্দীদের সাজা কার্যকরের জন্য নেয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা। কারাভ্যন্তরে বিশাল জমিতে রান্নার জন্য সবজি বাগান তৈরি করার কাজ শুরু করা হয়েছে। কারাভ্যন্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ছায়ার জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানো হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ এপ্রিল এ কারাগারটির শুভ উদ্বোধন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কারাভ্যন্তরের বিভিন্ন স্থানে অতি দ্রুত ছায়ার জন্য রেইনট্রি গাছ লাগানো হয়েছে। আগের কারাগারটিতে ২ হাজার ৬শ’ ৮২ বন্দীর স্থলে প্রায় ৮ হাজার বন্দীকে রাখা হতো। নতুন কারাগারটিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার বন্দীর স্থলে অনায়াসে দ্বিগুণ বন্দী রাখা সম্ভব হবে। জানা গেছে, জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বন্দীর থাকার জন্য স্থান (টয়লেট, বারান্দা ও থাকার স্থানের মাঝখানের ফাঁকাসহ) মোট ৩৫ স্কয়ার ফুট স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। বন্দীর সুবিধার্থে নতুন কারাগারটিতে প্রতিটি বন্দীর জন্য সব মিলিয়ে ৯০ স্কয়ার ফুট করে জায়গা রেখেই তৈরি করা হয়েছে। যা জাতিসংঘের দেয়া স্থানের তুলনায় কারাগারটিতে প্রায় ৩ গুণ বেশি স্থান রাখা হয়েছে। ফলে অনায়াসেই বন্দীরা থাকতে পারছেন। স্থানান্তরের পর আশপাশের কোন স্থানে বন্দীর সঙ্গে দেখা করতে আসা স্বজনদের বসার বা খাবার পানির ব্যবস্থা না থাকায় তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানের জন্য বৃত্তাকার ক্যান্টিনের চারপাশে টিন দিয়ে বসার জন্য শেড তৈরি করার কাজ শুরু করেছে। এছাড়া দর্শনার্থীদের জন্য খাবারের পানির সুব্যবস্থা করা হয়েছ। নির্দিষ্ট কোন ভবন তৈরি না করায় সাক্ষাত করার জন্য আগে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে লাইন ধরে টিকেট কাটতে হতো। অস্থায়ীভাবে রোদ থেকে দর্শনার্থীদের রক্ষায় প্রাথমিকভাবে চারদিকে খোলা রেখে উপরে ত্রিপল দিয়ে ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। তবে কয়েকদিনের মধ্যে একটি স্থায়ী শেড নির্মাণ করা হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন। এছাড়া দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বৃহৎ আকারের একটি কাফেটারিয়া নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী এক মাসের মধ্যেই এটির নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে। নতুন কারাগারটির প্রকল্প এলাকায় মোট ১শ’ ৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির উপর তৈরি করা হয়েছে। কারা এলাকার মধ্যে ২টি পুরুষ কেন্দ্রীয় কারাগার ও একটি মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে কারাবন্দী ও সাধারণ নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য ২শ’ শয্যার একটি হাসপাতাল তৈরি করা হবে। যার কাজ এখনও শুরু করা হয়নি। বর্তমানে শুধু পুরুষ কারাগার-১ চালু করা হয়েছে। আর অন্য দুটি কারাগার নির্মাণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি পুরুষ কারাগারে ৪ হাজার ৫শ’ ৯০ পুরুষ বন্দী রাখা যাবে। এর বাইরে ২শ’ ৭০ নারী বন্দীকে মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা সম্ভব হবে। নতুন কারাগারটি মোট ৩৪ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে। অপর পুরুষ কারাগারটিও সমপরিমাণ জমিতেই তৈরি করা হবে। এর মধ্যে মূল কারাগারটি ৩০ একর জমিতে তৈরি করা হয়েছে। প্যারামিটার ওয়ালের বাইরে কারা ব্যারাক ও কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য পৃথক পৃথক ভবন তৈরি করা হয়েছে। কারাফটকের সামনেই তৈরি করা হয়েছে অস্ত্রাগার। সামনেই তৈরি করা হয়েছে খাদ্যগুদাম। কারাবন্দীদের সাক্ষাতের জন্য দ্বিতল বিশিষ্ট একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। আগের কারাগারে বিভিন্ন স্থানে একেকটি অফিস থাকলেও নতুন কারাগারে কারা সংশ্লিষ্ট সকল অফিসকে এক স্থানে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। ভবনটির সামনেই কারাবন্দীদের জন্য কারাভ্যন্তরে খাবার পাঠাতে একটি বড় ক্যান্টিন তৈরি করা হয়েছে। বন্দীদের খাবারের সুবিধার্থে কারাভ্যন্তরে অতি দ্রুত প্রিজন্স ক্যান্টিন (পিসি) চালু করা হবে বলে জানা গেছে। স্থানান্তরের পর প্রতিটি ভবনে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবস্থা চালু না করতে পারায় বন্দীদের খুঁজে বের করতে অনেকটা সমস্যা হয়েছে। পরে কারা কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ভবনে সাউন্ড বক্স লাগানোর কাজ সম্পন্ন করায় যে কোন বন্দীকে সহজেই খুঁজে বের করা সম্ভব হচ্ছে। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা ছেড়ে কারাবন্দীরা খোলামেলা পরিবেশে যাওয়ায় তাদের মাঝে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। মুক্তিপ্রাপ্ত নাসির নামে এক বন্দী প্রতিবেদককে বলেন, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের কারাগারটি ছিল একটি জাহান্নাম। বিশাল আয়তনের পাশাপাশি খোলামেলা পরিবেশ আর পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকায় এ কারাগারটি সেই কারাগারের তুলনায় অনেকটা জান্নাত সমতুল্য। এ কারাগারটির ওপরের কোন তলায়ই বৈদ্যুতিক কোন পাখার প্রয়োজন হয় না। পুরনো কারাগারটিতে থাকা অবস্থায় আবাসন সমস্যার কারণে আমাদের গাদাগাদি করে থাকতে হতো। যা অনেকটা সহ্যের বাইরে ছিল। বর্তমান কারাগারটিতে হাত-পা মেলেই রাতে থাকা যায়। তবে প্রথম কয়েকদিন আমাদের কষ্ট করতে হয়েছে। এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। তবে যে কোন কারাগারের তুলনায় এ কারাগারটিতে বিভিন্ন সুবিধা থাকলেও কিছু সমস্যার সময়মতো সঠিক সমাধান না হওয়ার কারণে বন্দীদের সর্বোচ্চ কল্যাণের জন্য বর্তমান সরকার নির্মিত এ বিশাল কারাগারে বন্দীরা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক খান সর্বশেষ কারাগারটি পরিদর্শন শেষে প্রকল্প কাজের মান ও দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি পরিদর্শন শেষে সরকারের কাছে ঐ দিনই কেরানীগঞ্জ কারাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক যুগ্মসচিব আব্দুল হককে সরিয়ে দিতে লিখিত মতামত দেন। পরে তার মতামতের ভিত্তিতে আব্দুল হককে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সরকার অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করতে বাধ্য হয়। রান্নার জন্য গ্যাস সংযোগ না থাকায় কারা কর্তৃপক্ষকে কাঠের লাকড়ি দিয়ে ৩ বেলায় নিয়মিত ২০ হাজারের অধিক বন্দীর রান্না করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য আরপি গেট বা প্রধান ফটক না তৈরি করায় প্রাথমিকভাবে বাঁশ দিয়ে বাধা দিয়ে কারাগারে আসা গাড়ি বা রিক্সাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারা এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে। নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি না করায় কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষে বিশাল আয়তনের কারা সীমানা পাহারা দেয়া অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে কারা এলাকায় স্থানীয় কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ ও র‌্যাবের প্যাট্রোল টিম টহল প্রদান করছে। জানা গেছে, কারা কর্তৃপক্ষ শুধু আবাসন সুবিধা প্রদান করতে না পারায় র‌্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে স্থায়ী নিরাপত্তা টিম বসাতে পারছেন না। কারাভ্যন্তরের রান্নাঘরে ব্যবহৃত পানি সরানোর কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে সাত হাজার বন্দীর জন্য রান্নার কাজের পানি রান্না ঘরেই আটকে থাকছে। ফলে বাধ্য হয়েই জমাকৃত পানির ওপরেই বাবুর্চিদের কষ্ট করে দাঁড়িয়ে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। সঙ্গে কাঠের চুলায় অসহনীয় ধোঁয়া তো রয়েছেই। সরেজমিনে দেখা গেছে, কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত সকল ভবন নির্মাণ না করায় অত্যন্ত কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। নির্মিত কারা ব্যারাকে কারারক্ষীরা গোসল করতে গেলে ওপর তলার টয়লেট থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে তাদের গায়ের ওপর। কারাগারের জেলারের বাস ভবনে পানি চুয়ে চুয়ে পড়ছে। কয়েকটি কক্ষের পার্শ্ব দেয়াল ফেটে যেতে দেখা গেছে। ভবনের নিচতলায় ও সামনের ড্রেনে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। মূল প্রশাসনিক ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বা বড় কোন প্রিজন্স ভ্যান প্রবেশ করতে পারে না। ফলে প্রতিদিনই বন্দী আনা নেয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশাল স্থান থাকা সত্ত্বেও মূল কারা ফটকটি ছোট করায় কারা কর্তৃপক্ষ বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য নক্সা অনুযায়ী একটি প্রাথমিক স্কুল নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা আজও নির্মাণই করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন কারাগারটিকে কিছু বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করে বন্দী রাখার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা দেশের নিরাপত্তার জন্যও অতি জরুরী। অন্যথায় সৃষ্ট সমস্যার কারণে যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে যে কোন প্রকার দুর্ঘটনা। বিষয়টির প্রতি সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নতুন এ কারাগারটিতে কিভাবে বন্দীরা কারাজীবন কাটাতে পারেন ও নিরাপত্তার পাশাপাশি সেবাদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ কারা এলাকায় নির্বিঘেœ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেন সে লক্ষ্যে অবিরাম কাজ করছি। বন্দীর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়েই সকল কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। কারাগার পরিচালনায় কিছু সমস্যা থাকলেও বন্দীর নিরাপত্তায় কোন সমস্যা হচ্ছে না। তবে নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য কারা এলাকার সীমানা প্রাচীরটি অতি দ্রুত নির্মাণ করা প্রয়োজন। সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম যে কেউ কোন স্থানে গেলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এক্ষেত্রেও তাই অনেক সমস্যা হচ্ছে। তবে অতি প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা প্রাথমিকভাবে ৩৬টি কারণ চিহ্নিত করে এগোচ্ছি।
×