ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গওহর গালিব

কবি হৃদয়ে তিনি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১২ আগস্ট ২০১৬

কবি হৃদয়ে তিনি

নিত্য দিনের নিঃশ্বাসে যখন দ্রোহ তার উত্তাপ ছড়ায় তখন শিল্পের চেয়ে প্রাণের দাবিই বড় হয়ে ওঠে। বাঙালী জাতিকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যে জঙ্গম সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে, ১৭৫৭ পর তা আর কখনই করতে হয়নি। দীর্ঘ এ যাত্রাপথে আমাদের কবি-সাহিত্যিকগণ সময়ের সাথে সাথেই হেঁটেছেন। তাঁদের সে যাত্রার বিচিত্র কলধ্বনি পুঞ্জিত হয়ে আছে সাহিত্যের ও ইতিহাসের পাতায়। দীর্ঘ সে যাত্রাপথের রং ছিল কখনও ধূূসর, কখনও লাল, কখনও সবুজ, আবার কখনও বা নীল। কিন্তু সে যাত্রা যখন সোহরাওয়ার্দীর বিশাল সমুদ্রের কিনারে এসে থমকে গেল, তখন সবাই দেখল সেখানে কেবল একটাই রংÑ লাল। সে লাল রঙের বিচ্ছুরণে মহান এক কবি জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে শোনালেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতাখানি। মহান সে কবি হলেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর বজ্রকণ্ঠে ৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা যুদ্ধের সময় পর্বে ও যুদ্ধোত্তর কালে বাঙালী জাতির কাছে এক নব ব্যঞ্জনার আশাবাদ। কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুকে এবং তাঁর সে বাণীকে যথার্থই চিহ্নিত করেছেন এ কবিতায় : শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। ... ... ... কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। [স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো] কবির সে বাণী বুকে ধারণ করে সারাদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল ভয়ঙ্কর এক কালদহে। সেই আয়োজনে আমাদের কবিরা এগিয়ে এলেন অন্য এক অস্ত্র হাতে। তাঁদের কলম বন্দুকের মতোই গর্জে উঠল। নিরন্তর মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের সেই আখ্যানে তাঁদের কবিতায় স্থান পেল লাল রং-এরই সাতকাহন। আমরা দেখলাম আমাদের কবিতা পৌঁছে গেল স্লোগানের কাছে, কবিগন দাঁড়িয়ে গেলেন মিছিলে ও ময়দানে। তাই তো কবির বাণী আর নিছক কবিতা নয় বরং হয়ে উঠল স্লোগানে মুখর : ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই আমাদের সংগ্রাম চলবেই। ... ... ... অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ চলবেই চলবেই আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’ [সংগ্রাম চলবেই/ সিকানদার আবু জাফর ] কবির এই স্লোগানের মধ্যেই উচ্চকিত হয়ে ওঠে আমজনতার জাগরূক মন্ত্র। কবির এ অঙ্গীকার সে কালের এক জীবন্ত অনুষঙ্গ। এভাবেই সে সময়ের কবিতা মুক্তিযোদ্ধার বন্দুকের নলের মতোই হয়ে উঠেছিল সমান সাহসী। ইয়াহিয়া-আইয়ুবীয় ঘোড়ার খুড়ের শব্দ যখন চারদিক হতচকিত করে তুলছিল; তখন কবিদের পক্ষে আর নিস্তরঙ্গ আলোয়ানে বসে কবিতা লেখা সম্ভবপর হচ্ছিল না। মাঠে-ময়দানে, মিছিলে ও ফ্রন্টে বসেই তাদের কবিতা লিখতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের কবিতার শরীরে লেগে গেল রক্ত ও বারুদ, আর বর্ণমালায় মিশে গেল মৃত্যুর ধূপগন্ধ। জীবন ও দ্রোহ যখন হাত ধরাধরি করে চলে তখন নিছক ভাবাবেগ নয়, বরং কবিতায় ছায়া ফেলে পূর্ণভাবে মুক্তির আকাক্সক্ষা। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর আমাদের কবিরা তাদের চেতনায় হয়ে উঠেছেন সম্পূর্ণ মীমাংসিত। শিল্পের সৌকর্যে উন্নীত হওয়ার বাসনায় নয়, বরং কবিরা ধাবিত হলেন সমকালের যন্ত্রণাদাহের শাব্দিক অনুষঙ্গে। ৭ মার্চের ভাষণের পর আমাদের প্রস্তুতির পূর্বেই সামরিক জান্তারা হাজির হয় ২৫ মার্চের দঃস্বপ্ন নিয়ে। এই কালরাত্রির রক্তস্র্রোতে ভাসতে ভাসতেই আমাদের কবিরা কবিতার বিষয়-বৈভব নির্মাণ করলেন। কালরাত্রির সে দুঃস্বপ্নে কবিরা তাদের বোধ ও বোধিকে চিহ্নিত করলেন এভাবে : ‘ভয় করছে না, ভয় বা কাকে? না জীবন, না মৃত্যুকে, তারা তো কবেই গেছে পঁচিশে মার্চের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে।’ [একাত্তরের অনুভব থেকে/ আজীজুল হক] রক্ত-অশ্রু-ঘামের সে অন্তঃশীল দুঃখ দহন এভাবেই আচ্ছন্ন করেছিল আমাদের কবি-হৃদয়কে। স্বাভাবিকভাবেই কবিদের স্বরে ফুটে ওঠে বেদনার সুর। যন্ত্রণা, সংক্ষোভ ও দ্রোহাকাক্সক্ষার বিশাল সমুদ্রে আমাদের শব্দ ও বর্ণমালাগুলো ডাহুক পাখির মতো ডুব দিতে থাকে। ২৫ মার্চের পর রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দেশ ভস্মীভূত হয় বারুদ ও গ্রেনেডে। অগণিত শিশু-কিশোর, যুবা-নারী-বৃদ্ধ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় বিপন্নতার পথ ধরে। অবরুদ্ধ ও বিপন্ন সে সময়ের মূঢ়তায় বিমূঢ় হয়ে পড়েন আমাদের কবিরা। কিন্তু সময় অবরুদ্ধ প্রকরণে ঢাকা পড়ে গেলেও জীবনের প্রশ্নে অদমনীয় হয়ে পড়ে অভিঘাত। ফলে দেশ, জাতি ও জনগণের মুক্তির প্রশ্নে দ্রোহী হয়ে ওঠে কবি-হৃদয়। কবিগণ সামরিক সরকারের যাবতীয় নির্যাতন, নিপীড়ন ও আস্ফালনের বিপরীতে তাদের বোধকে যে জাগ্রত সত্তায় উন্নীত করেছিলেন, তার স্মারক খুঁজে পাই কবির এ কবিতায় : ‘আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি কোমল বিদ্রোহী প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র আমি জমা দেইনি।’ [আগ্নেয়াস্ত্র / নির্মলেন্দু গুণ ] এভাবেই কবির হৃদয় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল স্বাধিকার আদায় ও লাল-সবুজের দাবির প্রশ্নে। তাই নিরন্তন মৃত্যু ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে আমাদের প্রতিরোধের কবিতা। এখানে কবির বক্তব্য শত্রুর প্রতিরোধ ও মুক্তির চির বাসনায় হয়ে ওঠে সমকালের উজ্জীবিত-শক্তি। কিছুই ছিল না, তার পরও ‘হৃদয়ের মতো মারাত্মক একটি আগ্নেয়াস্ত্র’ সাথে নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম মহাসময়ে। মুক্তির আকাক্সক্ষায় শুধু বুকভরা সাহস নিয়ে আমরা হাজির হয়েছিলাম যুদ্ধের ময়দানে। সেই প্রতিরোধ ও ছুটে চলার শব্দে পরম মমতা নিয়ে তার ক্রোড়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় এই স্বদেশ। তাই তো কবি স্বভূমির এই জাগরূক সত্তাকে বাণীরূপ দিয়েছেন প্রিয় এই পঙ্ক্তিমালায় : ‘ঝোপঝাড়, নদীনালা, ফসলের ক্ষেত সমস্ত বাংলাই আজ কঠোর এ্যামবুশ সবুজ মানুষেরা আজ প্রত্যেকেই গেরিলা...।’ [ গেরিলা / হাসান হাফিজুর রহমান ] বিপন্ন সময়ে মানুষ ও মৃত্তিকা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছিল মুক্তির পথে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ‘গেরিলা’ ছিল একটি প্রত্যাশার নাম। আমরা ধন্য যে এ ভূমি আমাদের, কারণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী-বন-জঙ্গল মুক্তিসেনাদের গেরিলা আক্রমণের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল আশীর্বাদস্বরূপ। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-মাটি-মানুষের সমবেত প্রতিরোধ বাঙালী জাতির সোনালি স্বপ্নকে অবশ্যাম্ভাবী করে তুলেছিল। প্রাণের বিপুল প্রবাহ, স্বাধিকার আদায়ের প্রত্যাশা, সমস্ত বাধা ও বাঁধন ছিঁড়ে সূর্যের মতো দ্বীপ্ত হয়ে উঠেছিল। সমস্ত অনাচার ও অন্যায়ের বিপরীতে প্রাণের সে প্রবাহ ছিল পাহাড়ী নদীর মতো নির্ভয়। অস্থির সময়ে তরঙ্গায়িত সে জয়যাত্রাকে রুখতে পারে, যুদ্ধের সমাপ্তিপর্বে এমন শক্তি আর কারও ছিল না। তাই তো খলের বিপরীতে উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় নতুন এক সূর্যকে কবি চিহ্নিত করলেন এভাবে : ‘ঐ দ্যাখো স্বাধীনতা জ্বলছে, স্বাধীনতা: চৈতালী সূর্য, আর নয় মৌখিক উক্তি আমি যে তোদেরি প্রাণ-সূর্য শেষবার চাই আজ মুক্তি।’ [স্বাধীনতা জ্বলছে / দিলওয়ার ] এই মুক্তির নেশাতেই সমগ্র বাঙালী ভুলে যায় বুলেট আর বৃষ্টির পার্থক্য। তাই তো আমরা দেখি বুলেট ও বোমার গানে গানে ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালীর দ্রোহ চেতনার দীপ্তি। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে আমাদের সময় ছিল সংঘর্ষময়, আর জীবন ছিল রক্তাক্ত ও উত্তপ্ত। হল্লামুখর সে সময়পর্বে আমরা পতিত হয়েছিলাম ভয়ঙ্কর এক দুর্বিপাকে। কিন্তু সে দুর্বিপাক আমরা কাটিয়ে উঠেছিলাম শপথের দৃপ্ত অঙ্গীকারে। বাংলাদেশ তখন বিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের মতোই জেগে উঠেছিল দারুণ এক অগ্নিমন্ত্রে। বারুদের বৃষ্টি থেকে বাঙালীরা বয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সুবাতাস। বয়ে আনা, ছিনিয়ে আনা, সে সুবাতাসের ইতিকথা তাই তো কবি ঘোষণা করেন এক নীরব দ্যোতনায় : ‘তোমাদের হাড়গুলো বাংলার হৃৎপি-ে অবিনাশী ঝড় বাঙালীর জন্মতিথি, রক্তে লেখা ষোলো ডিসেম্বর।’ [বাঙালীর জন্মতিথি / মুহম্মদ নূরুল হুদা ] অতঃপর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ষোলোই ডিসেম্বরে বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উদিত হলো, পুনর্জন্ম হলো বাঙালী জাতির। ষোলোই ডিসেম্বরের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মহৎ সেই কবিতা লাল সবুজের পতাকা হয়ে উড়ছিল সারা বাংলায়।
×