ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সেই কাক্সিক্ষত রাত আর এলো না

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১২ আগস্ট ২০১৬

সেই কাক্সিক্ষত রাত আর এলো না

সৈয়দ হক চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার (১০ মে ২০১৬) কিছুদিন আগে আমাদের রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের একটি অনুষ্ঠানে ঢাকা ক্লাবের দোতলায় সিনহা অডিটোরিয়ামে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশিষ্ট গবেষক ড. মীজানুর রহমান শেলী। আমরা সেদিন কবি ও সংগঠক, টাংগাইল নিবাসী মাহমুদ কামাল এবং তরুণ ব্যবসায়ী খায়রুল মজিদ মাহমুদকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেছিলাম। অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি, আমরা গল্পগুজব করছি। আমি হক ভাইকে একসময় জিজ্ঞেস করলাম, হক ভাই আমি এখনও আপনার ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটি পড়ি কেন? রসিক মানুষ হক ভাই। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘যেহেতু তুমি এখনও তরুণ’। সে দিন আমার পাশে ছিল আমার শ্রেণী বন্ধু বিশিষ্ট অনুবাদক অধ্যাপক ফখরুল আলম। উত্তর শুনে তিনিও হো হো করে অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়লেন। এর কিছুদিন পর তাকে টেলিফোন করলাম। একটি সাহিত্য মাসিক হক ভাইএর সাক্ষাৎকার ও অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা চেয়ে ছিল আমার কাছে। এসব আমি অনেক করেছি। দেশী-বিদেশী লেখকদের উপর আমার অসংখ্য অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা আছে। পরে ‘সাক্ষাৎকার, ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য’ শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলা বাজারের ‘অয়ন প্রকাশনী’। বই এর পাতা উল্টাতে যেয়ে দেখি অন্য অনেক স্বনামধন্য লেখক-লেখিকার মতো হক ভাইও আমার বইটিতে নেই। আসলে দ্বিতীয় খ- করার কথা ছিল। আমার অসম্ভব অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততা ও অলসতার কারণে তা হয়ে উঠেনি। হক ভাই কিছু মনে করেননি। তিনি জানেন তার লেখালেখির আমি একান্ত নিবেদিত পাঠক। একনিষ্ঠ ভক্ত। আমি বললাম, টেলিফোনে কয়েকটি প্রশ্ন জেনে নিই। তা’ছাড়া আপনার গল্প, উপন্যাস, নাটক, সাহিত্য বিষয়ক কলাম দীর্ঘ তিন চার দশক ধরে গভীর একাগ্রতার সঙ্গে পাঠ করে আসছি। তিনি একটুও বিরক্ত হলেন না। আমার বিচিত্রসব প্রশ্নের উত্তর প্রগাঢ় আন্তরিকতার সাথে দিয়ে গেলেন। আমি বরং ক্লান্ত হয়ে পড়লাম একট সময়ে। তিনি বললেন, ‘রাতে টেলিফোন করো’ অথবা ‘গুলশানের বাসায় আসতে পারো।’ আমার হাতে সময় নেই মোটেই। আমি রাতে টেলিফোন করার প্রতিশ্রুতি দিলাম। কিন্তু সেই কাক্সিক্ষত রাত আর এলো না। ঢাকা শহরের নানাবিধ ব্যস্ততা আর আড্ডায় জড়িয়ে পড়ায় আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি। তারপর শুনলাম তিনি লন্ডন গেছেন। স্ত্রী কথাসাহিত্যিক সৈয়দা আনোয়ারা হককে সাথে নিয়ে চিকিৎসার জন্য। খবরটা শুনে খারাপ লাগলো। আমার সব প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া হয়নি। হক ভাই এর লেখা সেই ঊনসত্তর সাল থেকে যখন তিনি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন, তখন থেকে পড়ি। আমার সংগ্রহে হক ভাই-এর প্রায় সবগুলো বই ছিল সেগুলো কিন্তু এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। লন্ডন জীবনের উপর ভিত্তি করে তার পাঁচটি উপন্যাস সমগ্র ‘বালিকার চন্দ্রকথা ও অন্যান্য’ বইটি কিনলাম সেদিন, শ্রেষ্ঠ গল্প, শ্রেষ্ঠ কবিতা এবং নাটক সমগ্র কিনলাম সংগ্রহে রাখার জন্য। আমি ঢাকার বাইরে যেখানে থাকি, সেখানে ঢাকার মতো আড্ডা নেই, সামাজিকতার ব্যস্ততা নেই, অফুরন্ত সময় পড়ে থাকে হাতে। প্রতি বৃহস্পতিবার যখন ঢাকায় আসি ইংরেজী বাংলা এবং সাহিত্যপত্রিকা, বই কিনে নিয়ে যাই। শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত একান্ত আমার সময়। বিশ্ববিদ্যালয় ডরমিটরিতে আমি একা। এই সময়টা একান্ত আমার। সকাল এবং দুপুরে বিশ্রামের পরও কিছু সময় থাকে। আমাদের শ্রেণীবদ্ধু আলী ইমামের মতো আমি কর্মঠ নই। এ পর্যন্ত তার শিশু-কিশোর সাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের উপর সাড়ে পাঁচশ’র উপরে বই বেরিয়েছে। সেদিন টেলিফোনে সে বলছিল, ‘আমি সময় নষ্ট করিনি। পুরোটাই কাজে লাগিয়েছি।’ আর আমি? আমি শুধু পড়েছি, সেই তুলনায় খুব কম লিখেছি।
×