ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ই.এম ফস্টারের ওপর লেখা দাও...

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১২ আগস্ট ২০১৬

ই.এম ফস্টারের ওপর লেখা দাও...

দৈনিক বাংলার সাহিত্যসাময়িকীর দায়িত্বে ছিলেন তখন কবি আহসান হাবিব। বলা চলে, সেই সময়ে, সেই উনিশ’শ বাহাত্তরে, আজকের মতো এতো অসংখ্য পত্রপত্রিকা ছিল না। যে ক’টা ছিল, তার মধ্যে দৈনিক বাংলার সাহিত্যসাময়িকী ছিল অন্যতম, সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রহমান এবং বেশ জনপ্রিয়। আমার প্রথম গল্প ‘শেষ ট্রেন চলে গেছে’ এই সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল। একদিন কবি আহসান হাবিব ভাই আমাকে ডেকে বললেন, তুমি ইংরেজীর ছাত্র ই.এম ফস্টারের ওপর একটা পরিচিতিমূলক লেখা দাও। এখানকার অধিকাংশ লেখকরা বাইরের সাহিত্য সম্পর্কে কিছুই জানে না।’ প্রস্তাবটা নিঃসন্দেহে লোভনীয়। এই লেখাটির জন্য এবং আমাকে তিনি বেছে নিয়েছেন, এটা আমার জন্য কম লাঘার বিষয় নয়। কিন্তু আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমাদের পাঠ্যমসূচীতে ই.এম ফস্টারের মাত্র একটি উপন্যাস ‘অ্যা প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’ রয়েছে। আমি উপন্যাসটি পড়ছি, এখনও শেষ করে উঠতে পারিনি। আমি খুব খোলামেলা ভঙ্গিতে আমার সীমাবদ্ধতার কথা কবুল করে নিয়ে বললাম, হাবিব ভাই, আমিতো ই.এম ফস্টার সম্পর্কে তেমন একটা কিছু জানি না। হাবিব ভাই একটু যেন রেগে গেলেন। প্রচ- আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ই.এম ফস্টার গতকাল মারা গেছেন, এই সপ্তাহে নিউজ উইক এবং টাইম পত্রিকায় তার সম্পর্কে লেখা বের হবে। তুমি সংখ্যা দুটো কিনে ফেলো, আর তোমার পাঠ্যসূচীর উপন্যাসটা ভালো করে পড়ে নিয়ে একটি পরিচিতিমূলক লেখা তৈরি করে দাও। সেই আমার শুরু। টাইম এবং নিউজ পত্রিকার এ পৃষ্ঠায় ই.এম ফস্টার সম্পর্কে এত তথ্য, এত বিশ্লেষণ, এত বিষয় ছিল যে, আমি পেপারকাটিং দুটো একটা ফাইলে অন্তর্ভুক্ত করলাম। অনার্সে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল আমার এই লেখাটা এবং অই দুই প্রবন্ধ। লেখাটা ছাপা হওয়ার পরে হাবিব ভাই আরেকদিন ডেকে বললেন, তুমি বিদেশী সাহিত্য সম্পর্কে মাসে অন্তত একটি নাতিদীর্ঘ লেখা দিও। আমি আমার অন্য অনেক প্রতিশ্রুতির মতো এটাও রাখতে পারিনি। তখন আমি গল্প, কবিতা, নাটক আর শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনের আড্ডা নিয়ে এমন মত্ত হয়েছিলাম যে, কিছুতেই সময় বের করতে পারিনি। এখন ভাবলে আপসোস হয়। নিজের উপর অভিমান হয়, সময় কিভাবে সময়ের হাত ধরে চলে গেল। শাহাদত চৌধুরী তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক। একই হাউস থেকে বের হতো সাপ্তাহিকীটি। সেখানে সাহিত্যপৃষ্ঠা দেখতো আমাদের শ্রেণীবন্ধু শাহরিয়ার কবির। তিনি বাংলাসাহিত্য পড়তেন। কিশোরদের জন্য উপন্যাস লিখতেন। তিনি ছবিসহ গল্প ছাপার উদ্যোগ নিলেন। বিচিত্রা যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল, সাহিত্য বিভাগটিও কম জনপ্রিয় ছিল না। সেখানে আমি ও আমার সমসাময়িকদের গল্প ছাপা হতো। আমার ‘মোহনরাতে মরা চাঁদ’ গল্পটি ’৭২ সালের সম্ভবত: সেপ্টেম্বরে ছাপা হয়েছিল। তারপর আরো অনেক গল্প ছাপা হয়েছে। বিদেশী নাট্যকারদের উপর, ব্রেখট প্রমুখদের নিয়ে লিখেছি, অ্যাবসার্ড ড্রামা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছি। একটি রম্য পত্রিকায় হাল্কা বিষয়ের পাশাপাশি সিরিয়াস বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবির, আর তাকে পেছন থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, যিনি আর্ট কলেজ থেকে পাস করেছিলেন, কিন্তু নিয়মিত ছবি আঁকেননি, পত্রিকা নিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। শাহাদত ভাই বেঁচে নেই, শাহরিয়ার বেঁচে আছেন। তিনি এখন রাজনীতি নিয়ে মগ্ন আছেন।
×