ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদ মান্নান

জনকের রক্ত ছাড়া আমি আর কিছুই দেখি না

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১২ আগস্ট ২০১৬

জনকের রক্ত ছাড়া আমি  আর কিছুই দেখি না

পাকদস্যু অবশেষে পরাজয় বরণ করেছে: সোনার আসনে বসে স্বপ্ন দেখে আলালের ঘরের দুলাল; এবার চাষার ঘর ভরে যাবে আশার আলোয়; রক্তের অক্ষর দিয়ে লেখা হবে বাঙালির নাম ও ঠিকানা। যৌবনের উষালগ্ন : মুহূর্তেই বদলে যায় স্বপ্নের অদৃশ্য ভাষা, কিশোর হঠাৎ আর কিশোর থাকে নি- লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মা থেকে তার হাতে উঠে আসে অচেনা আলোর খোঁপা, স¦প্ন আর যুদ্ধজয়ী নাঙা তলোয়ার; বাঁকা খাপে ঢাকা হলো রক্তমাখা গোধূলীর রাঙা অভিসার। [তারিখ ১৮ জুলাই ১৯৭২; সন্দ¦ীপের গ্রাম্যপথ ডুবে গেল বৃষ্টিজলে; কী তুমুল বৃষ্টি ও তুফান! সব কিছু তুচ্ছ করে দেওয়ানা মজনুর মতো জনকের ডাক শুনতে সদলে কিশোর ছোটে ঢাকা অভিমুখেÑ আল্লাহর অশেষ কৃপায় সমুদ্রের জলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যায় দ্বীপের রাখাল] পোড়ো ঘরবাড়ি শোকাচ্ছন্ন পাহাড়ের খাদ উপত্যকা ফেলে জরাজীর্ণ ছোট্ট রেলগাড়ি বিধ্বস্ত বন্দর ছেড়ে ধীরে ধীরে সেই নগরের দিকে ছুটতে থাকে যে-নগরে বসবাস মহান পিতার; কী দারুণ উত্তেজনা, উন্মাদনা সেই নগর যাত্রায় ফেরি পারাপার; বিধ্বস্ত ভৈরব : ট্রেনের দু’বগির মাঝখানে ঝুলতে ঝুলতে ফুলবাড়িয়ায় অবতরণ অতৃপ্ত ঘোরের নেশা কী যে সর্বনাশ ডেকে আনতে পারত সেই ভয় আর আতংকের ভয়ংকর স্মৃতি সহজে ভোলার নয়, কাউকেই বোঝানো যাবে না। অতঃপর একুশে জুলাই সকাল দশটায় বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জন্মতীর্থ রেসকোর্স মাঠে পিতাকে নতুন রূপে সন্তানেরা আবিষ্কার করে। [বাঙালির গৌরবের প্রিয় সংগঠন, কতিপয় ষড়যন্ত্রী যুবকের লোভের শিকার : চারিদিকে জীবনের অন্ধ করতালি, লোভের মোহর পাতা দল ছুট অস্ত্রবাজ অই হার্মাদ বাহিনী ] মনে পড়লে আতঙ্কে এ বুক আজও কাঁপে নব্য দেশদ্রোহী কতিপয় দুর্বৃত্তের ছুড়ে মারা গ্রেনেডের ভয়ংকর শব্দÑ এ দুঃসহ স্মৃতি এখনও বহন করছিÑ কী করে বহন করি! আঁকাবাঁকা রেললাইনÑ গজেন্দ্র গতিতে হাঁটছে ট্রেন, অজস্র মৃত্যুর ফাঁদ পথে পথে তখনও রয়েছে; তবু সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়; তুচ্ছ! কেন?... জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুÑ গগন বিদারী স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত অন্ধকারে ডুবে থাকা তরুলতা বিষণœ নদীর ধারা। অবিনাশী ‘জয়ধ্বনি’ কণ্ঠে তুলে সেদিনের এক জরাজীর্ণ নগরে প্রবেশ করে নগ্ন পায়ে জলের কিশোর : বুক জুড়ে লেলিহান উত্তেজনা, চোখে জ্বলে জনকের সোনালি দিনের অন্তহীন স্বপ্নের বারুদ; হাজার হাজার ছাত্র জনতার কী তুমুল অন্ধ করতালিÑ আপন ভঙ্গিতে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন আমাদের পিতা : আকাশের সীমা ছুঁয়ে বসে থাকা বিশ্বজয়ী জনকের জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তৃতীয় বারের মতো শোনা হলো জীবনের দীপ্ত জয়গান। চৈতন্যের বেলাভূমি ডুবে গেছে শোকের জোয়ারে : কিশোরের সকল অস্তিত্ব জুড়ে বহমান মহান পিতার সেই সতত উজ্জ্বল স¥ৃতি চির অমলিনÑ আমাকে আচ্ছন্ন করে, দুঃসময়ে সাহস জোগায় অতঃপর শুরু হলো সর্বনাশা আত্মঘাতী খেলা, এ খেলায় ছিন্নভিন্ন গৌরবের রক্তমাখা এ জাতির সবুজ হৃদয় : ভেতরে বাইরে অই বুনো হিংস্র জানোয়ার এক হয়ে লুণ্ঠন করেছে জননীর যাবতীয় সৌন্দর্য ইজ্জত; আমাদের রক্তে পাওয়া অতি উঁচু গৌরবের পবিত্র ভূমিকে রাতারাতি পরিণত করে ভ্রাম্যমাণ পতিতার নিশিকুঞ্জ! ছি Ñ এ লজ্জা কোথায় রাখি, কোন বনে গিয়ে ঢাকি বিবস্ত্র শরীর! কালের দেয়ালে শুধু লেখা আছে জনকের রক্তে আঁকা সেই অভিশপ্ত নগরীর গাথা ও কাহিনী। হ্যাঁ, এ সেই নগরÑ যার অলিতে গলিতে আর ক্লেদজ শোণিতে আজও লকলক করে লতিয়ে উঠছে ঐ মৃত্যুশিখা; জঙ্গীর লেবাস গায়ে কুড়াল চাপাতি আর চাইনিজ অস্ত্র হাতে গোপন গুহায় হিংস্র জন্তুগুলো ওঁৎপেতে বসে আছে; পশুদের ভয়াল থাবায় আজ প্রায় ছিন্নভিন্ন মানবতা আর অই জায়নামাজ; মাতৃগর্ভে অনাগত শিশুকেও গুলিবিদ্ধ করা হলো কোন রঙ এবং রেখায় এ নির্মম চিত্র আঁকা যায়! আগস্ট শোকের মাস; এ জাতির কান্নাগুলো গাছের পাতায় আর কবিতার খাতায় খাতায় হাজার বছর ধরে জমা হবে অবিরাম বৃষ্টির ফোঁটায়; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাশূন্যে প্রিয় পিতৃমুখ অন্ধকার ভেদ করে উঁকি দেবে মেঘের কুসুমে : যান্ত্রিক উল্লাসে ভরা এই বুনো নগরীর ছাদে হয়তো ফুটবে ফুল হরেক রকম, সুখ ও শান্তির জন্য নগরবাবাসীরা সবে প্রার্থনা সভায় একাগ্রে মিলিত হবে; পথ চলতে চলতে শিশুরা মায়ের হাতে তুলে দেবে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া স্বাধীনতার স্বর্ণচাপা প্রেমিকা হারিয়ে যাবে প্রেমিকের খোলা বুক ধরে কৃষাণ কৃষাণী মিলে ভরে তুলবে ফসলের গোলা চাঁদও কলঙ্ক ধুয়ে বাতাসে উড়াবে তার জ্যোৎ¯œার রুমাল চারিদিকে আনন্দের এত সব আয়োজন, এত ছড়াছড়ি তবু কেন আমি এতটা এতিম আগস্ট এলেই কেন নিজেকে আমার বড় বেশি অপরাধী মনে হয় জনকের রক্ত ছাড়া আমি আর কিছুই দেখি না।
×