ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হজ মুবারক

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১২ আগস্ট ২০১৬

হজ মুবারক

ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম হচ্ছে হজ। হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হজ ফরয করা হয়েছে সেই সব মুসলিমের ওপর ফরজ যাদের মক্কা শরীফে যাওয়ার দৈহিক আর আর্থিক সামর্থ্য আছে। আমাদের দেশের মানুষকে এক সময় মুম্বাই (বুম্বাই) গিয়ে জাহাজে করে হজ করতে যেতে হতো। অনেকেই হেঁটে হজ করতে যেতেন। এখন তো প্লেনে হজে যাওয়ার অত্যাধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের চট্টগ্রাম থেকে স্টিমারযোগে হজে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। সৌদি সরকার স্টিমারে হজ পরিবহনের জন্য একটি বিলাসবহুল স্টিমার বাংলাদেশকে দিয়েছিলেন। এই স্টিমারের সর্বশেষ নাম ছিল বিএন সালাহুদ্দীন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে বিএন সালাহুদ্দীন শেষ বারের মতো হজযাত্রীগণকে বহন করে। এই শেষ বছরেই স্টিমারযোগে হজে যাওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছিলাম। তারপর বেশ কয়েকবার আমি হজে গিয়েছি। প্লেনযোগে কিন্তু স্টিমারযোগে হজে যাওয়ার যে আনন্দ আমি পেয়েছি তা প্লেনে চেপে হজ করার মধ্যে পাইনি। প্লেনে ঢাকা থেকে জেদ্দা যেতে সময় লাগে মাত্র ছয় ঘণ্টা। জেদ্দা এয়ারপোর্ট পৃথিবীর বৃহত্তম এয়ারপোর্ট। এর অনেক টার্মিনাল রয়েছে। হজ টার্মিনালও বেশ বড়। এর স্থাপত্য কৌশলও সুন্দর। অনেক তাঁবু যেন থরে থরে সাজানো। জেদ্দা বিমানবন্দরে হজ মৌসুমে প্রতি দুই মিনিট অন্তর প্লেন ওঠানামা করে। তখন এই বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এয়ারপোর্টে পরিণত হয়। হজের মৌসুম শুরু হয় মাহে রমজানের মাসব্যাপী সিয়াম পালনের পর ১ শাওয়াল ঈদ-উল-ফিতরের দিন থেকে আর হজ অনুষ্ঠিত হয় জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখে। প্রয়োজনে ১৩ তারিখ পর্যন্ত মক্কা মিনা আরাফাত মুযদালিফা স্থানসমূহে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন পালনের মাধ্যমে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : হজ হয় সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে (হজের নিয়তে ইহ্রাম বাঁধার মাধ্যমে) তার জন্য হজের সময় স্ত্রী সম্ভোগ, অন্যয় আচরণ ও কলহ বিবাদ বৈধ নয়। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু কর আল্লাহ্ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয়র ব্যবস্থা করবে, আত্ম সংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ, তোমরা তাক্ওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারা: আয়াত ১৯৭)। হজ নিয়ত অনুযায়ী তিন প্রকারের আর তা হলো হজে কিরান, হজে তামাত্তু, হজে ইফরাদ। হজের ফরজ তিনটি আর তা হচ্ছে : ইহ্রাম, ৯ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান এবং তাওয়াফে ইফাদা বা তাওয়াফে যিয়ারত বা ফিরতি তাওয়াফ। হজে মোটামুটিভাবে ওয়াজিব হচ্ছে : নির্দিষ্ট জায়গা (মীকাত) থেকে ইহ্রাম বাঁধা, সাফা-মারওয়া পর্বতদ্বয়ের মধ্যে দৌড়ানো (সায়ী), কা’বা শরীফ ৭ বার তওয়াফ করা, ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা (উকুফে আরাফাত), ১০ জিলহজ রাতে মুযদালিফা এসে রাতযাপন করা (উকূফে মুযদালিফা), মুযদালিফা এসে মাগরিব ও ‘ইশার সালাত আদায় করা, মুযদালিফা থেকে মিনা এসে জামায়াতুল আকাবা বা বড় শয়তানকে একে একে ৭টি কঙ্কর মারা, ১১ ও ১২ জিলহজ তিনটি শয়তানকে লক্ষ্য করে প্রত্যেকটিকে একে একে ৭টি কঙ্কর মারা, ১০ তারিখে মিনা এসে বড় শয়তানকে লক্ষ্য করে কঙ্কর নিক্ষেপ। (রমী) করা, মাথা মু- না করা, মাথার চুল একেবারে চেছে ফেলা অথবা ছেঁটে ফেলা, কিরান এবং তামাত্তু হজপালনকারী পশু কোরবানি দেয়া, কা’বা শরীফ তওয়াফ ডান দিক থেকে করা, পায়ে হেঁটে করা, অজু অবস্থায় তওয়াফ করা, তওয়াফ শেষে দুই রাক’আত সালাত আদায় করা, তরতীব রক্ষা করে প্রত্যেকটি হুকুম পালন করা, মীকাতের বাইরে ব্যক্তির জন্য বিদায়ী তওয়াফ করা, হাতীমের ভেতর দিয়ে তওয়াফ না করা। হজে প্রায় ১৫টি সুন্নত রয়েছে। হজের সঙ্গে অনেক ইতিহাসের ঘটনা জড়িয়ে আছে। আরাফাত সময়ে মূল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় মক্কা মুকাররমা থেকে সোজা পুবে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিস্তীর্ণ আরাফাত ময়দানে, আরাফা মানে জানাজানি। হযরত আদম আলায়হিস সালাম বেহেশত থেকে আমাদের এই ধরাধামে এসে প্রায় তিন শ’ বছর পর তাঁর স্ত্রী হাওয়া ‘আলায়হাস সালামের সঙ্গে মিলিত হন এবং সন্ধ্যা নেমে এলে তাঁরা আরাফাত থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মুযদালিফায় এসে রাতযাপন করেন। কা’বা গৃহ নির্মাণে তাঁর স্মৃতি রয়েছে। মিনা নামক স্থানে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ঘটনা এবং এখানে তাঁরা শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মক্কার সাফা-মারওয়ার সঙ্গে হযরত হাজরা ‘আলায়হাস সালামের পানি সংগ্রহের জন্য দৌড়ানের ঘটনার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যমযম কূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হযরত হাজরা আলায়হাস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামের স্মৃতি। জানা যায়, হযরত হাজরা (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর মাজার শরীফ কা’বা শরীফের হাতীম সংলগ্ন স্থানে রয়েছে, হাতীমকে হযরত ইসমাইলও বলা হয়। হজ বিশ্বমানবতার ঐক্যের প্রতীক। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হজ পালনকারী সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করে বলেছিলেন : হে মানুষ! আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো তোমাদের একের ধন-সম্পদ মান-ইজ্জত এবং জান-প্রাণ এসবের নিকট অলঙ্ঘনীয় পবিত্র হজ বরকতময়, প্রাচুর্যে ভরা এক পবিত্র বিধান। হজ মুবারক! লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×