ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

কানাডার ‘বেগম নগরীর’ বেগম সাহেবা কি ঘরে ঘরে?

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১২ আগস্ট ২০১৬

কানাডার ‘বেগম নগরীর’ বেগম সাহেবা কি ঘরে ঘরে?

পাচার, পাচার, পাচার। টাকা পাচার, ক্যাশ ডলার পাচার, মালামাল পাচার, গরু-ছাগল পাচার, নারী-শিশু পাচার, এমনকি পুরুষ শ্রমও পাচার। যতই দিন যাচ্ছে মনে হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি, সর্বোপরি বিশ্বায়ন এবং উদারীকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাচারও বাড়ছে। আইনের যত কড়াকড়ি বেআইনী কাজের তত বাড়াবাড়ি। গণতন্ত্রের (!) প্রসার যত আইনবহির্ভূত কাজের অগ্রগতি তত! তা না হলে প্রতিদিন, হ্যাঁ, প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন খবরের কাগজে নানাবিধ পাচারের খবর থাকবে কেন? ‘পাচার’ শব্দটিই বেআইনী কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইদানীং দেখা যাচ্ছে পাচার, বিশেষ করে অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়ে চলেছে, যদিও দেশে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ বলে জবরদস্ত একটা আইন আছে। এতদসত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে পাচারের পর পাচারের খবর। গত ৯ ও ১০ আগস্ট দুটো খবরের কাগজে দুটো বড় ধরনের অর্থ পাচারের খবর ছাপা হয়েছে। ৯ তারিখের খবরটির শিরোনাম : ৪২৩৪ কোটি টাকা পাচার বন্ধ প্রতিষ্ঠানের নামে। ১০ তারিখের খবরটির শিরোনাম : অফশোর ব্যাংকিং পাচার ৩৪০ কোটি টাকা। প্রথম খবরটির উৎস ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর)। খবরে বলা হয়েছে ‘এনবিআর’-এর একটি প্রতিবেদনে ২২৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের ঠিকানা ব্যবহার করে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ৪২৩৪ কোটির উপরে অর্থ দেশ থেকে পাচার করেছে। নির্দেশনা চেয়ে নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানের সবই ‘বন্ড’ সুবিধাপ্রাপ্ত পোশাক রফতানিকারক। এরা বিদেশ থেকে বিনা শুল্কে রফতানির জন্য কাঁচামাল আমদানি করেছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক হলেও সেই মাল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয়নি। না করে ঐসব মাল খোলাবাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হয়েছে ঐসব তথাকথিত পোশাক খাতের মালিকরা। এই মালিকরা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মালামাল আমদানি করার নামে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে ‘এনবিআর’-এর তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এই ঘোরতর অপরাধ করেছে, ‘বন্ড’ সুবিধার অপব্যবহার করেছে, খোলাবাজারে বেআইনীভাবে পণ্য বিক্রি করেছে, ভুয়া সনদপত্র, কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণপত্র খুলেছে তাদের অধিকাংশের মালিকই এখন লাপাত্তা। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনেক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ভুয়া। এদিকে দ্বিতীয় খবরটি একটি ব্যাংকের ‘অফশোর ব্যাংকিং’ সংক্রান্ত। খবরে বলা হয়েছে, দেশের প্রথম প্রজন্মের বেসরকারী ব্যাংক এবি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৩৪০ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটানো হয় সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের চারটি কোম্পানির মাধ্যমে। ঘোরতর এই অপরাধের ঘটনাকে আমলে নিয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংশ্লিষ্ট এবি ব্যাংককে সংসদীয় কমিটিতে তলব করা হয়েছে। খবরে দেখা যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের যে প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়া হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানে দেশের বিখ্যাত একটি ব্যবসায়ী হাউসের (রহিম আফরোজ) শেয়ার মালিকানা রয়েছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী হাউসের শেয়ার ৪৯ শতাংশ। অফশোর ব্যাংকিংয়ের এসব অনিয়ম বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটে ধরা পড়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে এসব ঋণ সমন্বয় করতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এই পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু টাকা উদ্ধারও হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট খবরে বলা হয়েছে। টাকা পাচারের উপরোক্ত দুটো ঘটনায় কোন্্ ধরনের ব্যবসায়ী জড়িত এটা প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন কোন্্ মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে। তৃতীয় প্রশ্ন এই ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর করণীয় কিছু আছে কিনা। শেষ পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী? প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ছোট বড় মাঝারি সব ব্যবসায়ী। বস্তুত বিদেশে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে সব ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরাই জড়িত থাকে। তবে উপস্থিত ক্ষেত্রে এমন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যাচ্ছে যারা বাজারে ‘সুনামের’ সঙ্গে ব্যবসা করছে। ভারতেও তাদের বিনিয়োগ আছে। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে প্রশ্ন হবে ব্যবসায়ীদের কোন অংশ অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত নয়। আমলা-কামলারা যে অর্থ পাচার করে তা সবার ধারণা ঐসব ব্যবসায়ীর মাধ্যমেই করে। বড় বড় ব্যবসায়ীর দেশের বাইরে অনেক বড় বড় শহরে অফিস আছে একথা জলের মতো পরিষ্কার। দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও খুব সহজ। বলাবাহুল্য, অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। সারাবিশ্বেই ব্যাংকগুলো অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। কিছুদিন পূর্বে ‘পানামা পেপারস’ নামীয় কেলেঙ্কারির যে খবর প্রকাশ হয় তাতে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৫০০ ব্যাংক ‘শেল কোম্পানিগুলোকে’ অর্থ পাচারে সাহায্য করেছে। এর মধ্যে বিখ্যাত ‘এইচএসবিসি’ নামীয় ব্যাংকের উল্লেখও আছে। এ কথা সর্বজনবিদিত, আমাদের দেশেও অর্থ পাচারের প্রধানতম মাধ্যম ব্যাংক। ব্যাংকের মাধ্যমে যে আমদানি-রফতানি-ঋণপত্র খোলা হয় ঐ ঋণপত্রের মাধ্যমেই ‘ওভার ইনভয়েসিং’ এবং ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ করা হয়। ‘আন্ডার ইনভয়েসিং (কম মূল্যায়ন) ও ‘ওভার ইনভয়েসিং’ (অতি মূল্যায়ন)-এর মাধ্যমে টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ১০ টাকা। ‘ইনভয়েসে’ তা দেখানো হলো ১৫ টাকা। ৫ টাকা বিদেশে পাচার হলো। রফতানির ক্ষেত্রে ১০ টাকার মালের দাম ৮ টাকা দেখানো হলো। এই ক্ষেত্রে দুই টাকা বিদেশে পাচার হলো। এই ‘মেকানিজমের’ মাধ্যমেই ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা দেশ থেকে টাকা পাচার করছেন। উল্লেখ্য, সারাবিশ্বেই ব্যাংকগুলো এই কাজে সহযোগিতা করছে। এতে সহায়তা করছে ব্যাংকের মালিকরা, বিশাল বেতনের লোভে উর্ধতন কর্মকর্তারা। ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইন দেশে দেশে জোরদার করার পর মনে করা হয়েছিল এসব বন্ধ হচ্ছে। বাস্তবে তা বেড়েছে বলেই অনেকের আশঙ্কা। আমাদের দেশও এর কোন ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশেও ব্যাংকগুলো অসাম্য ও বৈষম্য তৈরির অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকগুলো এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীকে ক্যাপিটাল ফর্মেশনে সাহায্য করছে। তারা পাকিস্তান আমলের মতোই ধনীদের আরও ধনী হতে অর্থ যোগান দিচ্ছে, গরিবের ভাগ্যে ঋণ জুটছে খুবই কম। ব্যাংকগুলো অনুন্নত অঞ্চলে অর্থ যোগান দেয় না। তারা বাজে গ্রাহকের পক্ষে কাজ করে। খেলাপীদের পক্ষ নেয়। ক্ষুদ্র ঋণে তাদের উৎসাহ নেই। আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরিতে তারা মদদ দিচ্ছে। খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং বরিশাল অঞ্চলে তাদের ঋণ যায় না। ঐসব অঞ্চলের ব্যাংকারও কম। ব্যাংকগুলো দারিদ্র্য বিমোচনেও খুব বেশি অবদান রাখছে না। ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যেও বেতন বৈষম্য তৈরি করছে। এমডিদের বেতন এবং পিয়নের বেতনের তারতম্য দেখলেই বোঝা যাবে এর সত্যতা। ব্যাংকাররা ধনী মালিকদের দাসে পরিণত হয়েছে। বস্তুত বিশ্বব্যাপীই ব্যাংক এ কাজ করছে। বাংলাদেশে তো বটেই। আর অর্থ পাচারে যে ব্যাংক সহযোগী শক্তি তা তো জলের মতো পরিষ্কার। পোশাক রফতানিকারকদের মধ্যে যাদের টাকা পাচারকারী বলে ‘এনবিআর’ চিহ্নিত করেছে তারা কিভাবে ঋণপত্র খুলল? দেখা যাচ্ছে ঠিকানাস্থ কারখানা বন্ধ, কাজ নেই। বন্ধ কারখানার ঋণপত্র খোলা হয় কিভাবে? ব্যাংক তা জানে না? ভুয়া ঠিকানা হয় কিভাবে? ‘কে ওয়াই সি’ (নো ইউর কাস্টমার) যেখানে নেয়া সেখানে কারখানার ঠিকানা ভুয়া হয় কিভাবে? যে পণ্য আমদানি করা হয় তা উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে- এই বলে সনদ দেয় ব্যবসায়ী সংগঠন (চেম্বার অব কমার্স)। এই সার্টিফিকেটের নাম ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি)। চেম্বার অব কমার্স, এই ক্ষেত্রে ‘বিজেএমইএ’ কিভাবে সার্টিফিকেট ইস্যু করল? আসলে অর্থ পাচারের ঘটনা ব্যাংক এবং চেম্বারের যৌথ প্রযোজনাতেই হয়। এসব অস্বীকার করে লাভ নেই। অস্বীকার করলে অনেক কিছুরই উত্তর পাওয়া যাবে না। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম ও ইথিওপিয়াতে বাংলাদেশীরা বিশাল বিশাল ব্যবসা কিভাবে করছে। শিল্প কিভাবে করছে? বাংলাদেশীরা কী দেশের ‘৫০০ টাকা, ১০০০ টাকার নোট’ বস্তা করে সেখানে নিয়ে গেছে? ‘ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যা-’সহ ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জের শেল কোম্পানিগুতে বাংলাদেশীদের টাকা জমা হচ্ছে কিভাবে? বাংলাদেশীরা বিদেশে ডলার পাচ্ছে কিভাবে? হু-িওয়ালা ও ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী, আমলা-কামলা, উঠতি ধনীরা কেন পাগলের মতো বিদেশে টাকা পাচার করছেন? প্রথম উত্তর তারা খুবই সহজে টাকা কামাই করতে পারছেন দেশে। এই রোজগারের জন্য দক্ষতা, মেধা, প্রতিযোগিতার কোন দরকার পড়ে না। দ্বিতীয়ত টাকা দেশে বিনিয়োগের কোন অবস্থা নেই। টাকা ব্যাংকে রাখারও কোন ব্যবস্থা নেই। টাকা জমা এবং তোলার প্রতিটি ক্ষেত্রে টাকার উৎস জানাতে হয় ব্যাংককে। যেহেতু এটা সম্ভব নয় বিপুল সংখ্যক ক্ষেত্রে তাই বিদেশে টাকা রাখা ছাড়া বিকল্প নেই। অনেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা বলেন। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। ঐ আমলে টাকাওয়ালাদের ‘অত্যাচার’ করা হয় বলে অভিযোগ আছে। এমতাবস্থায় টাকা বাইরে যাচ্ছে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, আমলা-কামলা কেন, সামাজিকভাবে একটু পরিচিত প্রায় সকলেরই ছেলেমেয়ে, পরিবার বিদেশে। অনেকেই সেখানকার নাগরিক। এমতাবস্থায় টাকা বিদেশে যাবেই। বোঝা যাচ্ছে যত বেশি কড়াকড়ি তত বেশি পাচার। বস্তুত এটাই উদারীকরণ, বাজার অর্থনীতির আরেক দিক। ব্যবসা-বাণিজ্য যখন উন্মুক্ত, টাকার গতি উন্মুক্ত থাকবে না কেন? টাকা চঞ্চল, চঞ্চল টাকা অঞ্চলে বেঁধে রাখা যায় না। যেখানে সে নিরাপদ বোধ করবে সেখানেই সে যাবে। সরকার কী পারবে ঐ টাকা দেশে ফেরত আনতে? আমি নিশ্চিত নই। কারণ কানাডার ‘বেগম নগরীর’ বেগম সাহেবা তো ঘরে ঘরে। কাকে কে ধরে? লোম বাছলে কম্বল মিছে হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে খালি গাল খেল হিন্দুরা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পঞ্চাশ টাকা, এক শ’, দুই শ’, পাঁচ শ’ টাকায় বাড়িঘর বিক্রি করে যখন তারা পশ্চিমবঙ্গে, অসম ও ত্রিপুরায় যায় তখন গাল হলো: খাও এখানে টাকা রাখ কলকাতায়। এখন কে কাকে গাল দেবে? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×