ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজনীন বঙ্গবন্ধু ॥ আমাদের সুরক্ষা প্রাচীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১২ আগস্ট ২০১৬

বিশ্বজনীন বঙ্গবন্ধু ॥ আমাদের সুরক্ষা প্রাচীর

বঙ্গবন্ধু কোথায় বিশাল সেটা এখন আর বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না। তাঁর তিরোধানের এত বছর পরও তিনিই নিয়ন্ত্রক। রাজনীতির যে জায়গাটা পচে-গলে একাকার, এমনকি তাঁর দলেও যেখানে অশান্তি আর আদর্শহীনতা সেখানেও তিনিই উদ্ধার। আমরা এমন এক জাতি যারা কাউকে মাথায় তুলতে যেমন দেরি করি না আবার আছড়ে ফেলতেও সময় লাগে না। এই একটিমাত্র মানুষ তাঁর কর্ম ও ব্যক্তিত্বে সে জায়গাটায় নিজেকে অটুট রেখেছেন। কি এমন মায়া কি এমন ভালবাসা আর তেজ সেটা আজকের রাজনীতিবিদরা হয়ত জানেন; কিন্তু তাদের হাতে তাঁর প্রকৃত চর্চার সময় নেই। আমরা বাংলাদেশের ভেতর একেক আমলে একেক ধরনের মানা না মানার খেলা দেখি। কয়েকবার করে দেশ শাসনে আসা বিএনপি আসলে একটি জগাখিচুড়ি দল। আমার মতে মুসলিম লীগের প্রেতাত্মা। রাজাকারদের প্রচ্ছন্ন মদদ আর স্বাধীনতা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতার দলটি এখন বড় নাজুক জায়গায়। তাদের এই হালের অন্যতম কারণ কিন্তু বঙ্গবন্ধুবিরোধিতা। একবার পেছন ফিরে দেখুন, যতদিন তারা শাসনে ছিল মহান নেতাকে যতভাবে আড়াল করা যায় তার চেষ্টা চলত। একাধিক প্রজন্মকে বহুকালের জন্য মূর্খ করে রাখতে চেয়েছিল তারা। পেরেছে? না পারার কারণ কি আজকের আওয়ামী লীগ না জনগণ না প্রকৃতি বা সময়? আসলে সময়ই শ্রেষ্ঠ উত্তরদাতা। যার রক্তধারায় এদেশের মাটি ভিজে গেছে, যিনি বুক দিয়ে এই দেশ ও মানুষকে আগলে রাখার জন্য জন্মেছিলেন তাঁকে আপনি না মানতে পারেন; কিন্তু তাঁর শোকাবহ মৃত্যু তথা হত্যার দিনে জন্মদিনের কেক কাটার মতো ঘটনা সময় এমনি ছেড়ে দেবে? অদূরদর্শী মওদুদ, নাজমুল হুদা বা ভাসানীর যাদুমিয়ার হাতে পড়া বিএনপি একবারও ভাবেনি সামনে কি আছে। তারা জানতেন তাদের সময়কালেও এই মানুষটির জন্য কিভাবে হরতাল পালিত হতো। ঐ একটি কাল দিনে বাংলার মানুষ নিজেদের সবকিছু গুটিয়ে ঘরে থাকার জন্য রাজি ছিল। কারণ, আমাদের ইতিহাসে এমন বড় নেতা আসেনি আর এত শোকাবহ ঘটনাও ঘটেনি। তারপরও চোরা নাহি শুনে কভু ধর্মের কাহিনী। সে সময় তো গেছে। এখন যখন আওয়ামী লীগ শাসনে তখনও তাঁকে ঘিরে চলছে নানা ধরনের বালখিল্যতা। বহু মানুষের দেশে এমন ঘটতে পারে। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে নজরদারির অভাব। সঙ্গে আছে অতি উৎসাহীদের ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি যে সুশীল সমাজ, যে বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও সাহসী মানুষরা দুর্দিনে এই নেতাকে সামনে এনে তাঁর ইমেজের নতুন কিরণ ছড়িয়েছিলেন তারা আজ কোথাও নেই। নেই সেই কর্মকা- বা বিশাল করার অভিপ্রায়। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, তাঁকে নিয়ে কথা বলে টিভি-রেডিওতে ফেনা তুললেই দায়িত্ব ফুরিয়ে যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে মৌলবাদ আর জঙ্গীত্ব তার পেছনে আছে দীর্ঘ সময়ের অপশাসন, ইতিহাস বিকৃতি আর নানা দেশের রাজনীতির ইন্ধন। যেসব দেশে তাঁর মতো মহীরুহ আছে তারা সে ছায়াতে থেকেই সমস্যা পাড়ি দিয়েছে বা দিচ্ছে। আজকের আওয়ামী লীগে তা থাকবে কিভাবে। সামনের সারিতে যেসব মুখ তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরোধিতা করতেন। কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুতে আনন্দিতও হয়েছিলেন। এরা কি পারবে তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে? আওয়ামী লীগের সামনে আর একটি বড় সমস্যা ইতিহাসের অতীতমুখী প্রবণতা। অতীত যদি শক্তি না হবে তো সে অতীত স্মৃতিছায়া আর কিছু না। তাকে কাজে লাগাতে হলে চাই গবেষণা আর মূল্যায়ন। সেটা কি হয়? না হচ্ছে আদৌ? বাইরে মানে বাংলাদেশের বাইরে দুনিয়ার সব দেশেই তাঁর নামে বিভিন্ন সংগঠন আছে। আমাদের সিডনিতেও বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভূমিকা ছিল জোরালো। এক সময় এই শহরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের আলোর মুখ দেখিয়েছিল এই সংগঠন। তাদের শোক দিবসের আয়োজনগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। নানা দিক থেকে এরা মহান নেতার জীবনী ও কাজের এতসব দিক তুলে ধরতেন তাতে মনে হতো বিদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের জায়গা হবে যার যার ঘরে অথবা নিজেদের ভেতর। সে বাস্তবতা আজ আর নেই। আজ এরা গুজবে অপপ্রচারে সামনের কাতারে এবং কি এক আশ্চর্য কৌশলে তারা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে এমন এক ভাব করে যাতে মনে হবে তাদের ভেতরও তিনি আছেন। আসলে এটা একটা জঘন্য কৌশল। আগে তাঁকে মেরে ফেলে, তাঁর চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে তারপর মায়াকান্না বা তিনি সবার ওপরে বলাটা গরু মেরে জুতাদানের সমতুল্য। আসল কাজটি হচ্ছে তাঁর দল ও স্বপ্নের বারোটা বাজানো। এদের উপদ্রবে বাঙালীর প্রগতিশীলতার যখন নাভিশ্বাস উঠছে তখন মাঠে নেই বঙ্গবন্ধু পরিষদ। থাকলেও নেই আগের তেজ বা ঝলসে ওঠার মতো আয়োজন। এটা একদিকে যেমন বেদনার, আরেকদিকে হতাশার। আমাদের নতুন প্রজন্মের ভেতর তাঁকে চেনা-জানার কাজটা জরুরী। যারা এদেশের সবুজ পাসপোর্টে গর্বিত বাংলাদেশী, যারা মানী-সম্মানী তারাও এর দায় বা দায়িত্ব নিতে চান না। ভারত, পাকিস্তান বা অন্যান্য দেশের মানুষ কিন্তু তাদের জাতীয় নেতা বা পিতার ব্যাপারে তর্ক করে না। করি আমরা। যতদিন সবাই একযোগে এটা না মানবে ততদিন মাঠে থাকার বিকল্প কোথায়? এটা মানতে হবে তিনি ও তাঁর চার সহকর্মীর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যে নেতৃত্ব শূন্যতা, যে অন্ধকার তৈরির জঘন্য ষড়যন্ত্রের শুরু সেটাই আমাদের অধঃপতনের সূচনা করেছিল। আজ তার ভয়ঙ্কর দানব আমাদের জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। বিদেশের বাঙালী নানাভাবে বিপদের বাইরে। তাদের জীবনে মৌলবাদের ছোবল থাকলেও দেশের মতো একমুখী বা আগ্রাসী হতে পারে না। তাদের আছে বিদেশী প্রতিরোধ ও রাষ্ট্রের সমর্থন। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিস্তার ও বিশালতা না থাকলে থাকবে কোথায়? আজ এত বছর পর আমরা যদি হিসাব করে দেখি দেখব সস্তা আবেগ আর কথার জালে আমরা তাঁকে আটকে ফেলছি। সেটা কারও জন্য শুভ হবে না। তিনি তাঁর জায়গায় আছেন এবং থাকবেন। আমাদেরই দরকার তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনা। প্রবাসের বাংলাদেশীরা হা-হুতাশ বাদ দিয়ে ঘর ও বাইরের শুভ কামনায় তাঁর প্রগতিশীলতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে যৌক্তিক আত্মসমর্পণ করুক। না হলে রবি ঠাকুরের ভাষায় ‘তোমার কথা হেথা কেহতো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল’ বলার বিকল্প থাকবে না। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধুকে আমরা যেন বিশ্বজনীন করে তুলতে পারি।
×