ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাশ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ॥ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

সৌদিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নাটোরের ৪ শ্রমিকের মৃত্যু ॥ পরিবারে মাতম

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১২ আগস্ট ২০১৬

সৌদিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নাটোরের ৪ শ্রমিকের মৃত্যু ॥ পরিবারে মাতম

নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর, ১১ আগস্ট ॥ সৌদি আরবের রিয়াদে একটি সোফা তৈরির কারখানায় আগুনে পুড়ে নাটোরের চার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় খাজুরিয়া গ্রামে চলছে শোকের মাতম। বুধবার রাত সাড়ে দশটায় নলডাঙ্গার খাজুরিয়া গ্রামে এ সংবাদ পৌঁছলে ওই ৪ পরিবারসহ পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ। এদিকে ৪ শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের লোকজন জানান, বুধবার সৌদি আরব সময় বিকেল পাঁচটায় রাজধানী রিয়াদের হারাজ বিন কাশেম মানফুহা এলাকায় একটি সোফা তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে আগুনে পুড়ে মারা যান বাংলাদেশী চার শ্রমিক নলডাঙ্গার খাজুরা শ্রীপুরপাড়া গ্রামের সৈয়দ আলীর ছেলে শামিউল ইসলাম ওরফে সাদ্দাম হোসেন (৩৪), খাজুরা জর্ণাদ্দনবাটি গ্রামের গফুর মোল্লার ছেলে জামাল হোসেন মোল্লা (৪৫), আজের আলীর ছেলে ওয়াসিম (২৭) ও খাজুরা ভাটোপাড়া গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম (৩৫)। বৃহস্পতিবার সকালে খাজুরিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পুরো গ্রামেই চলছে শোকের মাতম। ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছেন সাদ্দামের মা আসমা বেগম। তিনি বিলাপ করে বলছিলেন, ‘ও আমার বেটারে, তুই কোথায় গেলুরে, আমার বুকে ফিরে আয় ধন।’ তার এই আর্ত চিৎকারে সবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। সাদ্দামের বাবা সৈয়দ আলী জানান, ভিটেমাটি বিক্রি করে সংসারে একটু সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য দেড় বছর আগে সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছিলেন ছেলে। কিন্তু সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার আগেই জীবন প্রদীপ নিভে গেল তার। সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ পরিবারের সদস্যরা। সাদ্দামের মা ছামেনা বেগম বলেন, “বুধবার রাতে শুনেছি ছেলে যেখানে কাজ করত সেখানে আগুন লেগে পুড়ে মারা গেছে। আমার সংসারের সব শেষ হয়ে গেল।” একইভাবে মাতম চলছে ওয়াসিম, আমিনুল ইসলাম ও জামাল মোল্লার বাড়িতে। শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন স্বজনরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় আব্দুল ওহেদ ওরফে ওয়াসিমের মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে ভিড় করে আত্মীয়স্বজনরা। স্বজনের কান্নায় ওয়াসিমের পাঁচ মাসের ফুটফুটে কন্যা সন্তান আয়েশা খাতুনের মুখের হাসিও মলিন হয়ে গেছে। ওয়াসিমের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে রিপন হোসেন বলে, “আমাদের একটাই চাওয়া, বাবার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।” ওয়াসিমের স্ত্রী জানান, ঋণ করে ১২ বছর আগে সৌদি আরবে গিয়ে একটি সোফা কারখানায় কাজ করতেন ওয়াসিম। তিনি আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘রাতে হঠাৎ করে তার মৃত্যুর খবর শুনেছি।’ ’তিনি আরও বলেন, ‘দেশে আসবে বলে ছেলে-মেয়ের জন্য জামা-কাপড় কিনেছিল। কিন্তু তার আর দেশে ফিরে আসা হলো না। এখন দুটি সন্তান নিয়ে কোথায় যাব, কি করব।’ নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার জাহান বলেন, প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসকসহ অন্যদের জানানো হয়েছে। লাশ যাতে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সে জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খাজুরা ইউপির চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান জানান, উপার্জনক্ষম এই চার ব্যক্তির মৃত্যুতে তাদের পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়েছে। স্ত্রী-সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে চলতেন। এখন তাঁদের সে স্বপ্ন শুধু ভেঙ্গেই যায়নি, আগামীদিনে তারা কি করবেন, তা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনিও অবিলম্বে মৃত ব্যক্তিদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী আতিউর রহমান চার শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সাধারণত প্রবাসীদের দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণ যে দেশে কর্মরত সেই দেশের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে, দূতাবাসের মাধ্যমে এ ক্ষতিপূরণসহ লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা নেয়া হয়। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কাজটি যত দ্রুত সম্ভব করার জন্য আমরা সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বুধবার সৌদি আরবে নাটোরের নলডাঙ্গার যে চার শ্রমিক কারখানায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, তাদের লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে হাসপাতালে নিহত শ্রমিকদের লাশ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তারাও আছেন। আর কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ায় কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে।
×