ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরও সোচ্চার হোন ॥ আলেমদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১২ আগস্ট ২০১৬

আরও সোচ্চার হোন ॥ আলেমদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ উচ্ছেদে আলেম-ওলামাদের আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম এবং সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী কর্মকা- যে ইসলাম সমর্থন করে না এসব বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে কেউ আর বিপথগামী হবে না। আর ইসলামের নামে যারা বিপথগামী হয়েছে তাদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সেটা আলেম-ওলামাদের ঠিক করতে হবে। আসলে ইসলাম ধর্ম কী ও আমাদের জীবনযাত্রায় ইসলাম কী শিক্ষা দেয়- এসব বিষয় সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সমাজের ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ ও সচেতন হয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কওমী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষাদানের বিষয় ও পদ্ধতি ঠিক করতে প্রায় চার বছর আগে গঠিত কমিশনের কাজ দ্রুত শেষ করে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক কারিকুলাম ও সনদের আওতায় আনার তাগিদও দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে মানুষকে ইসলামের সংস্কৃতি শিক্ষা দিতে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, সবাই যেন বোঝে, যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস-জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে তারা আসলে এ ধর্মের কেউ নয়। আর মুষ্টিমেয় ব্যক্তির জন্য পবিত্র ধর্ম ইসলামকে খাটো করা যাবে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়ীর কৃষি ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক ওলামা সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ধর্মের নামে যারা জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে, তাদের প্রতিহত করতে ও ইসলামের সঠিক বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা দেশব্যাপী লক্ষাধিক উলামার স্বাক্ষর সংবলিত বিশেষ ফতওয়া জারি করে। অনুষ্ঠানে ৩০ খ- ‘ফতওয়ার’ একটি খ- প্রতীকী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন শোলাকিয়া ঈদ জামাতের গ্র্যান্ড ইমাম ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, শোলাকিয়া ঈদ জামাতের গ্র্যান্ড ইমাম ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার সভাপতি আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানগণ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান স্বামী ধ্রুবেশানন্দ মহারাজ, খ্রীস্টান ধর্মীয় প্রধান আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও, বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি শুদ্ধানন্দ মহাথেরোসহ বিভিন্ন ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকবৃন্দ এবং আলেম-ওলামা সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এবং সম্প্রতি জঙ্গী হামলায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। সম্মেলনে আলেম সমাজের পক্ষ থেকে কওমী মাদ্রাসা সনদ দেয়ার উদ্যোগ বাস্তবায়নের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সনদ দিতে হলে ন্যূনতম একটা কারিকুলাম দরকার। আমরা কওমী মাদ্রাসা কমিশন গঠন করে দিয়েছি। কিন্তু কারিকুলাম করার বিষয়ে কওমী মাদ্রাসার পাঁচটি বোর্ড একমত হতে পারেনি। সবাইকে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সবাই একমত হোন অথবা যারা আগ্রহী তারা একমত হোন, আমরা বাস্তবায়ন শুরু করে দেব। কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেয়া এ ফতওয়া জঙ্গীবাদ দূর করার পাশাপাশি ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব দূর করতে সহায়ক হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবকল্যাণ ও শান্তির জন্য আপনারা একটা মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন, এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। এটা আপনাদের নিজেদের কোন সৃষ্টি নয়, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরানে যা আছে, নবী করিম (স.) যা বলেছেন, তা থেকেই জাতির জন্য এই ফতওয়া তৈরি করেছেন আপনারা। নিশ্চয়ই এই এক লাখ আলেম কখনও মিথ্যা কথা বলবেন না। তারা সত্য কথা বলেন। আর এ ফতওয়া ইসলামের প্রতি মানুষের যে আস্থা ও বিশ্বাস তা অটুট থাকবে। ইসলামের নামে অঘটন ঘটিয়ে যারা এ ধর্মকে খাটো করছে, এই ফতওয়া তাদের রুখে দেবে। এটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ সবাই যেন বোঝে, যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে তারা আসলে এ ধর্মের কেউ নয়। আর মুষ্টিমেয় ব্যক্তির জন্য পবিত্র ধর্ম ইসলামকে খাটো করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে মানবিক ও উদার ধর্ম হলো ইসলাম। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখ লাগে তখন, যখন সামান্য কিছু লোক এই ধর্মকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালায়। আমাদের পবিত্র ধর্মকে মানুষের কাছে হেয় করে তারা কোন ইসলামের শিক্ষা নিচ্ছে? যে ইসলাম হলো শান্তির, সৌহার্দ্যের, সহনশীলতার সে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সন্ত্রাস চালাচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে তারা। দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ উচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য সুখবর। দেশের মানুষের মধ্যে জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ বিরোধী একাট চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। এই চেতনাটাকে আরও শাণিত করা দরকার। আপনারা যারা ধর্ম শিক্ষা দেন এটা মানুষকে আরও ভালভাবে বোঝাতে হবে এবং ওলামায়ে কেরামগণ এখানে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। আর কেউ যেন এই ভুল পথে না যায়। ইসলামের সঠিক শিক্ষাটা যেন সকলে পায় সে ব্যবস্থাটা আলেম-ওলামাগণকে নিতে হবে।’ ইসলামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শান্তির বাণী ইসলামই প্রথম ছড়িয়েছে-এটাকে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যাব। কারণ ইসলামের যে শৌর্য-বীর্য ছিল পুরনো ইতিহাস খুললে দেখা যাবে মানুষের জীবনমান উন্নত করার সব শিক্ষা কিন্তু আমরা সেখান থেকে পেয়েছি। তিনি বলেন, আজকে সামান্য কয়েকটা লোকের জন্য আমাদের এই পবিত্র শান্তির ধর্ম হেয় প্রতিপন্ন হবে সেটা কাম্য নয়। অবশ্যই এটা কোরআনের বাণী, আমাদের নবী করিম (সা.) এর বাণী এবং হাদিসে যা আছে তার ভিত্তিতেই আমরা ইসলামের সমৃদ্ধ মূল বাণীটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। যাতে করে আর কেউ বিভ্রান্ত না হয়। আমাদের ধর্মকে আর যেন কেউ হেয় প্রতিপন্ন করতে না পারে, বদনাম করতে না পারে। তিনি বলেন, এগুলো যারা করছে তারা তো আমাদের ধর্মটাকে একবারে হেয় করে দিচ্ছে। এটা সব থেকে কষ্টের, দুঃখের। তারা কি বুঝে করছে আমি জানি না। তারা কোন বেহেশত পাবে জানি না। তবে, মানুষ খুন করা যে কত বড় অপরাধ সেটা জানি। আর সামান্য কয়েকটা লোক ইসলামকে হেয় করবে এটা মেনে নেয়া যায় না। শেখ হাসিনা বলেন, যখন কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যাই, কেউ ইসলামিস্ট টেররিস্ট বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করি। সন্ত্রাসী কোন ধর্মের হতে পারে না। কিন্তু ভাবতে আমার নিজেরও কষ্ট লাগে। সামান্য কয়েকটা লোক কোথায় নিয়ে গেল আমাদের শান্তির ধর্মকে। যারা সন্ত্রাস করে, মানুষ হত্যা করে তারা আদৌ কোন ধর্মে বিশ্বাস করে কিনা সেটা দেখা দরকার। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আর কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকে রক্ষা করল। আরেকটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষ হত্যাকারী ও দুর্যোগ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে জড়িতদের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, তারা কোরআন, হাদিস, ইসলামের পবিত্র বাণী মানবে না, নামাজ না পড়ে মানুষ খুন করতে যায়, তারা কী করে বেহেশতে যাবে? মানুষ হত্যাকারীরা বেহেস্তে নয়, দোজকেই যাবে। তিনি বলেন, মানুষকে আরও ভালভাবে বোঝাতে হবে জঙ্গীবাদের পথ ইসলামের পথ নয়। কেউ যেন সন্ত্রাসের পথে না যায়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে। কিন্তু এখানে সুন্দর বিষয় হলো এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহযোগিতা করেন। এটা এদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন। এবারও ঈদের জামাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পাহারা দিয়েছে যেন নির্বিঘেœ সবাই নামাজ আদায় করতে পারে। আবার মুসলমান ভাইয়েরা এভাবে হিন্দুরা যেন পূজা-অর্চনা করতে পারে নির্বিঘেœ সে ব্যবস্থা করে। এভাবে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করেন। এটা আমাদের ইসলাম ধর্মই শিক্ষা দিয়েছে। ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকা-ের কথা উল্লেখ করে আবেগজড়িত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ওই হত্যাকা-ের ক’দিন আগে স্বামীর কর্মস্থলে চলে গিয়েছিলাম বলে আমরা দু’বোন রক্ষা পেয়ে যাই। মানুষ একটা শোক সইতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ আমাদের এত বড় শোক সইবার শক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ আমাদের ২২ জন নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। পরপর ১৩টি গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল আমার ওপরে। নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে বলে আমি রক্ষা পেয়ে যাই। আল্লাহর ইশারা ছিল বলেই রক্ষা পেয়েছি। সরাসরি গুলি করা হয়েছে। আমাদের কোটালিপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। একজন চা দোকানের সাধারণ মানুষ সেটা উদ্ধার করেছেন। সে যাত্রায়ও বেঁচে যাই। এটাও আল্লাহর ইশারা ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সেজন্য মনে করি, আল্লাহ কিছু কাজ দেন, সে কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহই তাকে রক্ষা করেন। এই বিশ্বাস নিয়েই আমি যত বাধা আসুক নির্বিঘেœ কাজ করার চেষ্টা করি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজে বেড়াচ্ছি, কোথাও আইএস খুঁজে পাইনি। বাংলাদেশে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের স্থান হবে না, আমরা খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবই। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের নিন্দা জানিয়ে মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ বলেন, ইসলাম উদারতা ও সহনশীলতার ধর্ম। কিছুসংখ্যক মতলববাজ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- করে পবিত্র এ ধর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ইসলামে অনর্থক গাছের পাতাও ছেঁড়া নিষেধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা মনে করে মানুষ হত্যা করে বেহেশতে চলে যাবে, তারা আসলে জাহান্নামে যাবে। যারা মানুষ হত্যা করে, আত্মহত্যা করে তারা উভয়ই জাহান্নামে যাবে। ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফরিদউদ্দীন মাসউদ বলেন, ইতিহাসে কারবালার ঘটনার পর এতো নিষ্ঠুর ও হƒদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই।
×