ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার;###;সাতটি ফেডারেশনের মধ্যে দুটি বাস সার্ভিসের;###;একটি ফেডারেশনের কাছে জিম্মি ১৮৬ ইউনিয়ন;###;মাসে ১২০ কোটি টাকা শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ;###;প্রতিটি ইউনিয়নকে দিতে হয় ৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত

৪০ লাখ শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কেউ ভাবে না ॥ চাঁদাবাজি ও আধিপত্যই যেন মূল কাজ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১১ আগস্ট ২০১৬

৪০ লাখ শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কেউ ভাবে না ॥ চাঁদাবাজি ও আধিপত্যই যেন মূল কাজ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত পরিবহন সেক্টর। এরই মধ্যে নানা সমস্যা মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে এই শিল্প খাতের বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের। বাস্তবতা হলো, তাদের অধিকার আদায় কিংবা সার্বিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কাজ করার কেউ নেই। দেখারও কেউ নেই। বলতে গেলে, বছরের পর বছর নানা বঞ্চনার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ বর্তমানে তালিকাভুক্ত পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সংখ্যা সাতটি। এর মধ্যে বাস পরিবহন খাতে সংগঠন দুটি। কেন্দ্রীয় এসব ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণে তালিকাভুক্ত ইউনিয়নের সংখ্যা ১৮৬। ইউনিয়নের আওতায় পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। অন্য ছয়টি সংগঠন নামসর্বস্ব। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষাসহ নানা ইস্যুতে ফেডারেশনগুলোর কাজ করার কথা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এমনটি ধারণা করা মোটেও অসঙ্গত হবে না যে চাঁদা আদায় ও আধিপত্য বিস্তার ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। প্রতিটি কেন্দ্রীয় সংস্থা ইউনিয়ন থেকে মাসিক হারে ইচ্ছেমতো চাঁদা আদায় করছে। শ্রম আইন অবজ্ঞা করে শ্রমিকপ্রতি দিনে ১০টাকা চাঁদা নিচ্ছে তারা। অর্থাৎ মাসে ১২০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে শ্রমিকদের কাছ থেকে। এই আয় থেকে ফেডারেশনের নেতারা পান বড় অঙ্কের মাসিক ভাতা। কেন্দ্রীয় সংস্থার চাপে প্রতিটি ইউনিয়ন আড়াই লাখের বেশি বাস-মিনিবাস থেকে ৭০-১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করছে। এরমধ্যে ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত ভাতা পান ইউনিয়নের নেতারা। এই আয়ের একটি অংশও পাচ্ছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাদের নির্দেশ না মানলে ইউনিয়নের নেতৃত্বে বসানো হয় পছন্দমতো ব্যক্তিকে। সব মিলিয়ে জিম্মি পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। অথচ শ্রমিকদের কল্যাণে কেন্দ্রীয় সংস্থার কোন ভূমিকা না থাকায় শ্রমিকদের ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চাঁদা তোলার কারিগর ॥ জাতীয় পর্যায়ে কিছু কেন্দ্রীয় সংস্থা কার্যক্রম চালাতে পারবে শ্রম আইনে এ রকম কোন নির্দেশনা নেই। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয়, শ্রম আইনে ফেডারেশনগুলোকে ইউনিয়ন থেকে চাঁদা তোলার বৈধতা দেয়া হয়েছে, তবে চাঁদার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি। এজন্য ইচ্ছেমতো চাঁদাবাজি চলছে মাঠ পর্যায়ে। এদিকে বিভিন্ন ইউনিয়ন ফেডারেশনের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে ইতোমধ্যে অন্য ফেডারেশনে যোগ দিয়েছে। কেউবা একলা চলো নীতি অনুসরণ করেছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রম আইনে ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি অনেকটা বৈধ হলেও দেশের সকল গণপরিবহন থেকে সরাসরি প্রতিদিন ১০টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। অটোরিক্সা শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফেডারেশনের নামে সারাদেশে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। চাঁদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারী কোন নীতিমালা না থাকায় ইচ্ছেমতো ইউনিয়নগুলোতে চাঁদা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। যেসব এলাকায় পরিবহন ব্যবসা ভাল সেখানে চাঁদার পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে প্রতিমাসে ফেডারেশনের চাঁদা মেটাতে ইউনিয়নগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিবহন নেতার অনেকেই বলছেন, জেলা, উপজেলা কিংবা আঞ্চলিক পর্যায়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর বস্তুত জনকল্যাণমূলক তেমন কোন কাজ নেই। সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু পরিচয়পত্র দেয়াই মুখ্য কাজ। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, কাজের পরিবেশ ঠিক রাখা, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকের জন্য মালিক পক্ষ থেকে টাকা আদায়, উৎসব বোনাস থেকে শুরু করে কোন কাজই শ্রমিক সংগঠনগুলো সঠিকভাবে করছে না। এছাড়া অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের কল্যাণে কল্যাণ ফান্ড গঠন কিংবা অবসর ভাতার বিষয়ে কোন তৎপরতা নেই। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত কোন পরিবেশ নেই। এই প্রেক্ষাপটে জনকল্যাণ বা ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠনগুলোর ভূমিকা কতটুকু হবে সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনগুলোর অনৈক্য ও বর্তমান বাস্তবতা সম্পর্কে শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি ইসরাফিল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকার আদায়ের অন্যতম শর্ত হলো ঐক্য। ভারত, আমেরিকা থেকে শুরু করে পাকিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি ন্যাশনাল ফেডারেশন তৈরি করেছে। সেখানে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শক্তিশালী। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমিক ফেডারেশন ও সংগঠন ঐক্যবদ্ধ না হয়ে দিন দিন বিভক্ত হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরে ৪২টি জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন আছে। এসব সংগঠন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরস্পরবিরোধী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ফেডারেশন ও ইউনিয়নের মধ্যে ভাগাভাগি। এ কারণে সেক্টরভিত্তিক ফেডারেশনগুলো থেকে ইউনিয়ন ভাল কোন সেবা পাচ্ছে না। সব দলই চায় শ্রমিক সংগঠনগুলো লেজুড়বৃত্তি করবে। তারা যেন ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। ব্যবসায়ী সকল সংগঠন মিলে এফবিসিসিআই করেছে। এভাবে শ্রমিকদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংগঠন জরুরী। তিনি বলেন, আমি শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকার সময় শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এক করার চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর জাতীয় নেতৃত্বে সমস্যা রয়েছে। তারা ব্যক্তিস্বার্থে পদ-পদবি ব্যবহার করে চলেন; যা ঐক্যবদ্ধ যাত্রায় হয়ত সম্ভব হবে না। সবাই মিলে এক হতে না পারলে শ্রমিকদের দৈন্য কাটবে না। দিন দিন দূরত্ব বাড়বে। জাতীয় পর্যায়ে সাত বাস শ্রমিক ফেডারেশন ॥ পরিবহন সেক্টরে জাতীয় পর্যায়ের শ্রমিক ফেডারেশনের সংখ্যা সাতটি। এরমধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন (১৭২৪)। এর কার্যকরী সভাপতি নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সভাপতি ওয়াজিউদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। মূলত সংগঠনটি গোটা পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত। বাম ঘরানার বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন (১৭১৫) নামে আরেকটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন নুরুল ইসলাম ও আলী রেজা। এই ফেডারেশনের তেমন কোন কার্যক্রম নেই। এছাড়াও রয়েছে, রায় রমেশের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ট্রাক ড্রাইভার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের নেতৃত্বে রয়েছেন সভাপতি কামরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ দেলোয়ার হোসেন। বাংলাদেশ ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন, বাংলাদেশ অটোরিক্সা শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে আছেন মোঃ ফারুক। এছাড়াও জনসংহতি শ্রমিক ফেডারেশন নামে আরেকটি জাতীয় পর্যায়ের ফেডারেশন থাকলেও কার্যত এটি নামসর্বস্ব। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল ওদুদ নয়ন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন একটি ফেডারেশন সকল শ্রমিক ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যে সরকার ক্ষমতায় আসুক তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন যুক্ত থাকে। এই সংগঠনের এখন একচেটিয়া আধিপত্য। তিনি বলেন, ফেডারেশনের মুষ্টিমেয় নেতা তাদের ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের উল্লেখযোগ্য কোন অবদান নেই বলে দাবি করেন তিনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ঢাকা জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের নাম দিয়ে আমাদের সংগঠন দখলের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা। ফেডারেশনগুলোকে সকল ইউনিয়ন চাঁদা দিতে বাধ্য। অন্যথায় নেতৃত্বের পরিবর্তনসহ তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের দিয়ে সংগঠন পরিচালনা করা হয়। চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ইউনিয়নগুলো ॥ ফেডারেশনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পরিবহন সেক্টরের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। এ নিয়ে ফেডারেশনের সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়নের চলছে ঠা-া লড়াই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নিয়ন্ত্রণে সারাদেশের ই্উনিয়ন। প্রবীণ শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য, ইউনিয়নগুলো তাদের শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে মাসিক চাঁদা নির্ধারণ করবে। এর একটি অংশ ইউনিয়নের পরিচালক ব্যয় আরেকটি অংশ ফেডারেশন মাসিক চাঁদা হিসেবে নেবে। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এক রকম জোরজবরদস্তি করেই মাসোহারা নিচ্ছে ফেডারেশন। ইচ্ছেমতো ইউনিয়নগুলোতে চাঁদার পরিমাণ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে নিজেদের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব ও কলহ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নকে মাসে দুলাখ টাকা করে চাঁদা নির্ধারণ করে ফেডারেশন। এতে কেন্দ্রীয় সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। এক পর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। শেষ পর্যন্ত ফেডারেশন থেকে ইউনিয়নটি বেরিয়ে যায়। ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন (গাবতলী) চাঁদাবাজির অত্যাচারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে গেছে। চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনের চাঁদাবাজির বিরোধিতা করে আসছে। এছাড়াও হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার ইউনিয়নের সঙ্গে অতিরিক্ত চাঁদা দাবিকে কেন্দ্র করে ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকপ্রতি ১০ টাকা ও বাসপ্রতি ৭০ টাকা চাঁদা আদায় ॥ বিভিন্ন ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০টাকা সরাসরি চাঁদা আদায় করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। অথচ যা শ্রম আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন পরিবহন শ্রমিক নেতার অনেকেই। তারা বলছেন, এই চাঁদা নেয়ার আইনগত কোন বৈধতা নেই। দিনে সারাদেশের পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা ওঠে চার কোটি টাকা। মাসে ১২০ কোটি। বছরে চাঁদা ওঠে এক হাজার ৪৪০ কোটি। ২০০১ সালে বিএনপি সরকারে আসার পর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা বাসপ্রতি ৫০ টাকা প্রতিটি ইউনিয়নের চাঁদা বৈধ করে। পরে ২০০৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই আদেশ বাতিল করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রা শুরুর পর ৭০ টাকা পরিবহন চাঁদার সুপারিশ করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এ নিয়ে তীব্র বিরোধিতা দেখা দেয়। এর আইনগত কোন বৈধতা না থাকার বিষয়টি সামনে তুলে আনেন শ্রমিক নেতার অনেকেই। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা বাতিল হয়। প্রতিটি বাস থেকে ৭০ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করেছে ফেডারেশন। যা ইউনিয়নগুলো নিজ দায়িত্বে উত্তোলন করবে। এরমধ্যে বাসপ্রতি ৪০টাকা মালিক সমিতি, ২০টাকা শ্রমিক ইউনিয়ন ও ১০ টাকা ফেডারেশন নেবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নিয়মও ভঙ্গ হচ্ছে। এর বাইরে শ্রমিকপ্রতি ১০টাকা ফেডারেশনের চাঁদাবাজি তো আছেই। শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদাবাজির বিরোধিতা করে ২০১০ সালের পাঁচ অক্টোবর ও ২০০৯ সালের ১৮ অক্টোবর বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়ে দুটি লিখিত আবেদন করা হয়। আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শ্রম পরিদফতরের পরিচালককে নির্দেশ দেয়। তদন্তে পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদাবাজির বিষয়টি প্রমাণিত হলেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ’৫৬ সাল থেকে বাংলাদেশ শ্রমিক ইউনিয়নের যাত্রা শুরু ॥ ১৯৪৭ সালের আগে ভারতে পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন ‘পালকি ইউনিয়ন’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর ভারতে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন নামে সংগঠনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। যার নেতৃত্বে ছিলেন মাইজউদ্দিন, আব্দুল গনিসহ অনেকেই। এরপর ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মূল নেতৃত্বের সংগঠন হিসেবে ফেডারেশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রবীণ শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, অধিকারবঞ্চিত সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা, রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি, গণপরিবহন নীতির আলোকে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সড়ক ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখাসহ বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করাই মূল উদ্দেশ্য শ্রমিক ফেডারেশনগুলোর। অথচ এ রকম কোন চর্চাই এখন ফেডারেশন কিংবা ইউনিয়নের মধ্যে নেই। এজন্য হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রবীণ শ্রমিক নেতার অনেকে। তারা বলছেন, শ্রমিক আন্দোলন এখন রাজনীতির কাছে কুক্ষিগত। জানতে চাইলে প্রবীণ শ্রমিক নেতা আলী রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় স্বার্থে শ্রমিকদের এখন আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। মূলত দলীয় স্বার্থে পরিবহন শ্রমিকদের ব্যবহার করছে ফেডারেশনগুলো। টার্মিনাল, ফেরিঘাট ও ওয়েস্কেল থেকে চাঁদা তোলাসহ দখলবাজি করাই এখন শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশনগুলোর মূল কাজ। শিল্প বা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ফেডারেশনগুলোর কোন কর্মসূচী নেই। শ্রমিকদের অনেকে জানেও না ফেডারেশন বা ইউনিয়নগুলোর মূল কাজ কি। বেসরকারী শিল্প খাতে চাঁদাবাজির বিরোধিতা করে তিনি বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। ইউনিয়ন থেকে ফেডারেশনগুলোর মাসিক চাঁদার লাগাম টেনে ধরার পরামর্শ দেন তিনি। ১৮৬টি রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন ॥ বর্তমানে সারাদেশে ১৮৬টি রেজিস্টার্ড পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত। সবই শ্রম পরিদফতর থেকে অনুমোদিত। প্রায় চার বছর ধরে নতুন শ্রমিক ইউনিয়নের অনুমোদন বন্ধ রেখেছে বোর্ড। ফেডারেশনের সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে গাবতলী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, গাবতলী বাস টার্মিনালে দুটি পক্ষ কাজ করছে। যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের সঙ্গে ইউনিয়নগুলো কাজ করে। তিনি জানান, গাবতলী থেকে ফেডারেশনের নামে একটি ইউনিয়ন গাড়িপ্রতি ৩০টাকা করে চাঁদা তুলছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী গাড়িপ্রতি ১৩টাকা ও কল্যাণ তহবিলের জন্য পাঁচ টাকার বেশি তোলা যায় না। অথচ ৩০টাকা নেয়া হচ্ছে। ফেডারেশনগুলো প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে তিন হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত মাসোহারা নিচ্ছে। গাবতলী থেকে মালিক সমিতির নামে গাড়িপ্রতি ২৪০টাকা তোলা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ফেডারেশনগুলোর মধ্যে আগের ঐক্য নেই। যে কারণে মূলধারা থেকে শ্রমিক আন্দোলন সরে এসেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীর সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। চাঁদাবাজি নিয়ে রাজধানীতে দুই শ্রমিক সংগঠনের দ্বন্দ্ব ॥ সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান টার্মিনাল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের অন্তত ৩০টি জেলার প্রায় আড়াই হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করে। দুই টার্মিনালের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলেছে, সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান টার্মিনাল হয়ে চলা প্রতিটি বাস থেকে শ্রমিক সংগঠনের নামে ৮০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সে হিসেবে দৈনিক চাঁদা আসে প্রায় দুই লাখ টাকা। এর বাইরে এই দুটি টার্মিনালে মালিক সমিতির নামে প্রতিটি বাস থেকে আদায় করা হয় ১০০ টাকা। শ্রমিক সংগঠন বশে থাকলে মালিক সমিতির চাঁদাও নিয়ন্ত্রণ করা যায় নির্বিঘেœ। সব মিলিয়ে দুই টার্মিনাল থেকে বছরে মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রায় ১৬ কোটি টাকা আদায় হয়। সূত্র জানায়, মূল শ্রমিক ইউনিয়নের বাইরে গুলিস্তান ও সায়েদাবাদ টার্মিনালের আলাদা কমিটি আছে। আরও নিচে আছে প্রতিটি রুটের কমিটি। চাঁদা তুলে রুট কমিটি। এর ভাগ যায় টার্মিনাল কমিটি, ফেডারেশন ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও। এর মধ্যে টার্মিনালের শৃঙ্খলা রক্ষা ও যানজট নিরসনের চাঁদাও আছে।
×