ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীকে জনগণের সেবা করতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১১ আগস্ট ২০১৬

বঙ্গবন্ধু ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদ জীবন দিয়ে জাতিকে রক্তঋণে আবদ্ধ করেছেন। তাঁদের সেই রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে। এ জন্য সরকারী সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জনগণের সেবক হয়ে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মাধ্যমেই তাঁর এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে। বুধবার সচিবালয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন। অনেক বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে আমরা জাতির পিতার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী দেশের নানা খাতে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আমরা জনগণের সেবক, জনগণের সেবা করব। জনগণের রক্ত ঘামঝরা অর্থ দিয়েই তো আমাদের বেতন-ভাতা সবকিছু- এ কথাটা যেন এক ূর্তের জন্যও ভুলে না যাই। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে নেই। কোন দিন গরিব-দুঃখীর ওপর অত্যাচার করবেন না। তিনি বলেন, যেকোন কাজ আমরা হাতে নেই না কেন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাদের (সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী) ওপর অনেকাংশে বর্তায়। কাজেই আপনারা আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজ সম্পাদন করবেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, পরে তাদের ষড়যন্ত্রেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা ফজিলাতুন্নেছা, আমার ভাই শেখ কামাল, জামাল, ছোট্ট রাসেলকেও তারা হত্যা করেছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা এবং দেশের কারাগারে আটক বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের তীব্র সমালোচনাও করেন। উদ্বোধনী পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী রক্তদান কর্মসূচী ঘুরে দেখেন এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে জাতির পিতার রক্তঋণের কিছুটা হলেও দায় শোধের এই মানসিকতা থেকে এদিন স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য সচিবালয়ের ৪২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তালিকাভুক্ত হন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রমুখ। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশে আরও বলেন, আমাদের এই কষ্ট, দুঃখ, ব্যথা-বেদনা ভুলেও দেশের জন্য, মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার যে চেষ্টা করে যাচ্ছি- এখানে আপনাদের সহযোগিতা সবসময় কামনা করি। দেশের সেবা করা যেকোন সরকারী কর্মচারীর একান্ত দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের খ- চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি, বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারি, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার একটি ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘সরকারের সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি তাদের যেন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে আপনারা তাদের অবশ্যই কাঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটি নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয় তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেইদিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাকেও সেজন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ আমি আপনাদের জাতির পিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকটি কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চাপে, আমার সহকর্মীদের ঘাড়ে চাপে। এজন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল, আমার অনুরোধ রইল, আমার আদেশ রইল- আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে নাই, আর কিছুতে হয় না। একটা গরিব যদি হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এজন্য কোনদিন কোন গরিব দুঃখীর ওপর অত্যাচার যেন না হয়, যদি হয় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার এই মহামূল্যবান কথাগুলো দায়িত্বে থাকা সকলেরই মনে রাখা উচিত। শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়েই জাতির পিতা জীবন দিয়ে গেছেন। এই ওয়াদা তিনি ৭ মার্চের ভাষণসহ বহু জায়গায় করেছেন এবং জীবন দিয়ে রক্ত দিয়ে সেই ওয়াদাই তিনি পালন করে গেছেন। সচিবালয়ের কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আজ আপনারা একটি মহৎ কাজ করতে যাচ্ছেন-রক্তদান। একজন রক্ত দেবেন আর একটি মানুষের জীবন বাঁচাবেন। রক্ত দিলে কোন ক্ষতি না হয়ে শরীরের জন্য উপকার উল্লেখ করে বলেন, নিয়মিত রক্ত দিলে শরীরে নতুন রক্ত কণিকা জন্মে এবং শরীর ভাল থাকে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও ৫৬-৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত রক্ত দিতেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি দেশে ফেরার পর থেকে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে প্রতিবছর আয়েজিত রক্তদান কর্মসূচীতে নিজেও রক্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও আর দিতে পারি না। রক্ত দেয়ার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি এখনও রক্ত দিতে প্রস্তুত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের আগে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বাঙালীর কোন অধিকার ছিল না। বঙ্গবন্ধু সব সময় বাঙালীর অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন। সে কারণে তাঁকে নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছে, ফাঁসি পর্যন্ত দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়ার পরও তিনি সব সময় ন্যায্য অধিকারের কথা বলেছেন। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় কর্মক্ষেত্রে পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত বৈষম্যের যে চিত্র উপস্থাপিত হয় তা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় পাকিস্তান সরকারে সচিবদের পদ ছিল ২২টি। যার সব ক’টির পদাধিকারী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা। যুগ্ম সচিব পদে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৪২ জন এবং বাঙালীদের ৮ জন। উপসচিব ৬৯টি পদে আসীন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা, অন্যদিকে ২৩ জন মাত্র ছিলেন বাঙালী। সেকশন অফিসার- পশ্চিম পাকিস্তানীরা ছিল ৩২৫ জন আর বাঙালীরা ৫০ জন। প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩৭৬৯ জন এবং বাঙালী ৮১১ জন। সিনিয়র গেজেটেড অফিসার-পশ্চিম পাকিস্তানী ৬৯২ জন আর বাঙালী ৪২ জন। সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও ভয়াবহ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩টি জেনারেল পদ, ২০টি মেজর জেনারেলের পদ এবং ৩৪টি ব্রিগেডিয়ারের পদের সব ক’টিতেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা আসীন ছিলেন। কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ছিল ৪৯ জন এবং বাঙালী মাত্র একজন। লে. কর্নেল পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ১৯৮ জন আর বাঙালী ২ জন। মেজর পদে- পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯০ জন আর বাঙালী ছিলেন ১০ জন। নৌবাহিনীর ৬শ’ পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী ৫৯৩ জন এবং বাঙালী ছিলেন ৭ জন। অন্যদিকে বিমানবাহিনীর ৬৪০টি পদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা ৬শ’ পদে আর বাঙালীরা ৪০টি পদে আসীন ছিলেন।
×