ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গানই জীবন সাধনা

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১১ আগস্ট ২০১৬

গানই জীবন সাধনা

বাংলার বাউল গান এখন বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এ স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো। বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ বলে ঘোষণা দিয়েছে। লালনের সাম্যবাদী চিন্তাই আজকের উদার মানবতাবাদ। লালন বলেছেন, ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে। যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।’ বস্তুত উনিশ শতকে লালনের গান তাঁর সর্বজনীন আবেদনের কারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লালনের কারণেই হিন্দু, মুসলমান সম্প্রদায়ের দেহতত্ত্ববাদীরা সব বিভেদ ভুলে যুত সাধনায় মিলিত হন। শিষ্য-ভক্তদের মাধ্যমে লালনের গান প্রচার ও প্রসার লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালনের কথা প্রচার করেন বহির্বিশ্বে। শহর-গ্রামে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে বাউল সঙ্গীত। সব ধরনের শ্রোতাই মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করে বাউল গান। এ গানের অসম্ভব জনপ্রিয়তার পেছনে আছে এর সর্বজনীনতা, গভীর মানবিকতা বোধ। যে কোন বিষয়ের তত্ত্ব, কিংবা সত্যকে অনুসন্ধান ও অনুধাবন করা পরিশ্রমের কাজ। এই পরিশ্রমটুকু স্বীকার না করে যে কোন বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য প্রদান করা দায়িত্বহীনতা। তরুণ প্রজন্ম বাউল সাধনা ও মরমী সাধনার মধ্যকার ফারাকটুকু অনুমান করতে পারছে কি? তবে এর পেছনে কেবল দায়িত্বহীনতা নয়, মাঝে মাঝে উদ্দেশ্য প্রবণতার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। বাউল সাধনা ও মরমী সাধনা সম্পূর্ণ পৃথক দুটি পথ। বাউল সাধক ও মরমী সাধক কখনও একই পথে হাঁটেন না। তাদের গন্তব্যও এক নয়। ফলে তাদের জীবনধারা ও ভাবকল্পনা সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলা যেমন আউল বাউলের দেশ; তেমনি মরমী ফকিরের দেশও। বাউলের আছে ‘আখড়া’, ফকিরের আছে ‘আস্তানা’। মরমী সাধকরা সব সময় ধর্ম শিক্ষার অনুকূলে তাদের বয়ান রচনা করেছেন। কেউ কেউ বলতে পারেন বা দেখাতে পারেন যে মরমী সাধকরা সংসারবিরাগী ছিলেন, কিন্তু এ বিষয়টিও তারা প্রমাণ করতে পারবেন না। মরমী সাধকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত আকাক্সক্ষা হতে মুক্ত থেকে ভোগ-বিলাসকে প্রত্যাখ্যান করায় আপাতদৃষ্টিতে তাদের সংসারবিরাগী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ভোগবাদের প্রতিকূলে তারা সব সময় সংসারেরই অনুরাগী এবং তাদের বয়ান কিংবা গীত সব সময় সংসারকে কেন্দ্র করে। তারা ইহকাল ও পরকালকে মিলিয়ে এক বৃহৎ সংসারের আকাক্সক্ষা করতে পারেন বলেই তারা মরমী। তাদের কাছে জগতের সঠিক মর্ম ধরা দেয় বলেই তারা মরমী। তাদের ফকিরও বলা হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণেও অনেকে ফকির কিংবা বাউল সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন অথবা তাদের বেশ ধারণ করেন। বাংলাদেশের মরমী সাধকদের মধ্যে ফকির লালন শাহ, ফকির দুদ্দু শাহ, ফকির পাঞ্জু শাহ, হাসন রাজা, জালালউদ্দীন, উকিল মুন্সি, শাহ আবদুল করিম, আবদুর রহমান বয়াতী সুপরিচিতি। আরেকটি বিষয় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়। সেটি হচ্ছে ক্ষ্যাপা বাউল আর ক্ষ্যাপী বাউলের বিষয়। মুসলিম মরমী সাধকদের আস্তানায় আমরা নারীদের দেখি না। তাদের অবস্থান আস্তানার পাশেই অন্দর মহল কিংবা নিজ গৃহে। অন্যদিকে ক্ষ্যাপী আর ক্ষ্যাপারা একসঙ্গেই তাদের আখড়ায় সময় যাপন করে, সাধনা করে। বাউল সাধক এবং মরমী সাধকদের মধ্যে একটি জায়গায় মিল পাওয়া যায়; তবুও সেটি উভয়ের বাহনমাত্র। মরমী সাধকরা জীবনসাধনার অংশ হিসেবে সঙ্গীত বা গানকে গ্রহণ করেন, সৃষ্টি করেন, ব্যবহার করেন। অন্যদিকে বাউল সাধকদের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে গান। এক্ষেত্রে গানই তাদের জীবনসাধনা। অথচ মরমী সাধকদের মূল সাধনা হচ্ছে মরমে পৌঁছার সাধনা। দক্ষিণখান, ঢাকা থেকে
×