ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তি ও মনোজাগতিক বিপ্লব পাশাপাশি নয় কেন? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১১ আগস্ট ২০১৬

প্রযুক্তি ও মনোজাগতিক বিপ্লব পাশাপাশি নয় কেন? -স্বদেশ রায়

‘দি বয় উইথ এ ব্যম্বু হার্ট’ উপন্যাসটি প্রকৃত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। এ উপন্যাসের শুরুর দিকে আছে কীভাবে রাস্তার এতিম বা পরিচয়হীন বাচ্চাদের সংগ্রহ করে কম্বোডিয়ার বিদ্রোহের শিশু গেরিলা তৈরি করা হয়। সেখানে তাদের নানাভাবে নির্মম ও হৃদয়হীন করার চেষ্টা করা হয় শুরু থেকে। একটা পর্যায়ে এসে তাদের হাতে বেয়োনেট দেয়া হয়। এরপরে গরুর রক্ত এনে তাদের হাতে, মুখে, বেয়োনেটে ওই রক্ত মাখিয়ে রক্তের সঙ্গে পরিচিত করা হয়। যাতে কিছুদিন পরে মানুষের রক্ত দেখে তারা শক্ত থাকতে পারে। এই সত্য ঘটনার যে নায়ক বা উপন্যাসের যে নায়ক সে কিন্তু শুরু থেকে ভাল করলেও নিজেকে ঠিক মানাতে পারছে না। কারণ, তার সঙ্গে আর যারা আছে তারা রাস্তার পরিচয়হীন বালক, আর সে গ্রামের অতি সাধারণ অথচ মমতা পরিপূর্ণ, সমাজ ও সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে ওঠা এক বালক- যে বাল্যকালেই তার পিতা ও মাতাকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে চলে আসে শহরে। সে প্রথমেই অস্ত্র পাচ্ছে, কিন্তু তার পরেও ভাবছে, আমার মা তো পতিতা নয়, আমি তো কোন পতিতার সন্তান নই। রাস্তার সন্তান নই। অর্থাৎ একটা কন্ট্রাডিকশন তার মনে প্রতি মুহূর্তে কাজ করে। যা পরে তাকে এক সুন্দরতম জীবনে নিয়ে যায়। তার বিস্তারিত এখানে নয়। এখানে লক্ষণীয়, একটি বালক বা কিশোরকে কীভাবে মানুষ হত্যার জন্য উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের নকশালদের কীভাবে নির্মম করে তোলা হয়েছিল, তার ওপরে কোন বই আজও প্রকাশিত হয়নি। বরং ইন্দিরা গান্ধীকে খাটো করার জন্য সেখানে বামপন্থীরা নকশালকে গ্লোরিফাই করেছে। ইন্দিরা গান্ধী ও সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যে পশ্চিমবঙ্গকে কী ভয়াবহ সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে গেছেন, সেই সত্য ইতিহাস এক ধরনের তথাকথিত মানবাধিকার ও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের নিজস্ব রাষ্ট্র ক্ষমতার স্বার্থে ঢেকে রাখা হয়েছে। অথচ যারা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, সুভাষ বোসের মূর্তি ভেঙ্গেছে তাদের সঙ্গে যারা আফগানিস্তানে বৌদ্ধ মূর্তি, সিরিয়ার হাজার হাজার বছর আগের মিউজিকের প্রতীক ভাঙছে এদের ভেতর কিন্তু কোন পার্থক্য নেই। এসব কিছুই কিন্তু ঘটে যখন বালক, কিশোর বা উঠতি তরুণের হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে হত্যা করে তাকে একটি অন্ধত্বের ভেতর ঠেলে দেয়া হয়। জন্মগতভাবে খুব কম মানুষই সুকুমারবৃত্তির অধিকারী হয়। মানুষের এই সুকুমারবৃত্তিকে পরিবেশ দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, ষাট থেকে সত্তর হাজার বছর আগে থেকেই এই সুকুমারবৃত্তি চর্চার একটি ধারা প্রবহমান। যে ধারাই মানুষকে মানবিক করে, মানুষ শুধু প্রযুক্তি নয়, মানুষের ব্রেনের কিছু অংশকে জাগিয়ে মানুষের হৃদয় কনসেপ্টকে করেছে অনেক বেশি উন্নত। মানুষকে দিয়েছে বিনয় ও কোমলতা। যা মানুষের জন্মগত বিষয় সবটুকু নয়, পরিবেশগতও অনেকখানিই। প্রযুক্তির গতিতে এসে মানুষ তাঁর পায়ের বদলে চাকা পেয়েছে, পাখার বদলে জেট বিমান পেয়েছে, এমনকি তাঁর ব্রেনের সহায়ক হিসেবে কম্পিউটার আবিষ্কার করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষ এখন রীতিমতো প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। প্রকৃতির ইচ্ছায় নয়, মানুষের ইচ্ছায় এখন উদ্ভিদের জন্ম হচ্ছে, প্রাণীর জন্ম হচ্ছে এমনকি উদ্ভিদের ফল, প্রাণীর ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সবই মানুষ বদলে দিচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তি এনে দিয়েছে এক সীমাহীন সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ। যে কারণে গত কয়েক দশক দেখা যাচ্ছে, মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। খুব কম মানুষই প্রযুক্তি ও সুকুমারবৃত্তিকে সমানতালে নিয়ে এগুতে পারছে। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব ও মানুষের সুকুমারবৃত্তি এগিয়ে নেয়ার বিপ্লব কিন্তু সমানতালে এগিয়েছিল। তাই ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর একটা বড় অংশ জুড়ে মানুষের মনোজগত তৈরির এক বিস্ময়কর যুগ। আধুনিক পৃথিবীতে এটাই মনে হয় মানুষের মনোজগত তৈরির সব থেকে সুবর্ণ সময়। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে একবিংশ শতাব্দীর এই সময়টা প্রযুক্তি ও মানুষের মনোজগত সমানভাবে এগোতে পারছে না। এর প্রকৃত কারণ আমাদের মতো সাংবাদিকদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে সাধারণ চোখে যা দেখা যায়, একবিংশ শতাব্দীতে পুরোপুরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় চলছে মানুষ। এখন ওই অর্থে আর সামাজিক নেতৃত্ব নেই। মানুষকে বেশি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করছে, রাষ্ট্র ও কনজুমার ব্যবস্থাপনার একটি অঙ্গ হিসেবে মিডিয়া। এ মুহূর্তের পৃথিবীতে একজন অর্মত্য সেনের চিন্তার থেকে বিজ্ঞাপনদাতাদের ক্ষমতা বেশি। অর্মত্য সেনের জনগণতান্ত্রিক অর্থনীতি মানুষের ওপর যতটুকু প্রভাব ফেলছে তার থেকে হাজার গুণ বেশি প্রভাব ফেলছে কনজুমার ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞাপন। তাছাড়া কনজুমার অর্থনীতিতে নতুন নতুন প্রোডাক্ট মানুষের জীবনকে এত সহজ করে দিচ্ছে যে কারণে, আমরা অধিকাংশই কিন্তু স্মার্টফোনের, ট্যাবের নতুন জেনারেশন গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি। অন্যদিকে প্রযুক্তি কোথায় চলে গেছে! প্রযুক্তিবিদরা এখন ভাবছে মানুষের সহকারী হিসেবে শুধু যান্ত্রিক কম্পিউটার নয়, কম্পিউটারে হিউম্যান ব্রেইন বসানো হবে। প্রযুক্তির এই চূড়ান্ত সময়ে মানুষের মনোজগত কীভাবে এগিয়ে নিতে হবে, মানব ব্যবস্থাপনা কীভাবে করতে হবে সর্বোপরি একটি শান্তিপূর্ণসহ অবস্থানের মানব সমাজের বিশ্ব কীভাবে গড়তে হবে এ অনেক কঠিন কাজ। দীর্ঘকাল যাবত পৃথিবী শাসন করছেন মিডিওকাররা। এক কোনায় কিছুকাল ম্যান্ডেলা ছিলেন। তিনিও নেই। তাই যে রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবীর মানব ব্যবস্থাপনা হচ্ছে, দীর্ঘকাল যাবত এর নেতৃত্ব মিডিওকার বা তার থেকে নিম্নমানের হাতে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে যেমন সমানতালে চিন্তা নায়করা এগিয়েছিলেন, বর্তমানের এই ডিজিটাল টেকনোলজির যুগে পৃথিবীতে ওই মাপের চিন্তা নায়ক নেই বললেই চলে। এই এক চরমতম ব্লাক হোলে ঢুকে গেছে পৃথিবী। পৃথিবীর এই চরমতম ব্লাক হোলের যুগে যদি পৃথিবীর কোন অংশে কোন মানব গোষ্ঠীতে চরম আকারের কোন অসুস্থতা নেমে আসে, মনোজগত যদি নির্মম হতে থাকে কোন মানব গোষ্ঠীর কোন অংশের- এ অসুখ সারিয়ে তোলা খুবই কঠিনতম কাজ। এ মুহূর্তের পৃথিবীর মোড়ল যে রাষ্ট্রটি সেই আমেরিকা কিন্তু আরও এই অসুখ ছড়ানোর পক্ষে। সে দেশের একজন প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট হিলারির যে ই-মেইল ফাঁস হয়েছে অর্থাৎ যে সকল রাষ্ট্রীয় ই-মেইল তিনি ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্ট থেকে পাঠিয়েছিলেন সেখানে দেখা যাচ্ছে, লিবিয়ার নিরীহ মানুষ ও তাদের নেতা গাদ্দাফীকে হত্যা করতে, সিরিয়ার বাসারকে উৎখাত করতে অস্ত্র পাঠানোর পরামর্শ হিলারিই দেন। এর থেকে বোঝা যায়, আমেরিকা পৃথিবীতে নানাভাবে অসুস্থতা বজায় রাখার চেষ্টা করবে, তাদের কনজুমার ইকোনমি ও দুর্বৃত্তায়নের ইকোনমির স্বার্থে। আর এরই বলি হতে হচ্ছে অনেক দেশকে। এতে যে শেষ অবধি আমেরিকা ভাল থাকবে তা কিন্তু নয়। তবে সে ভাবনার থেকে বড় ভাবনা হলো, ওই আগুনের আঁচ লেগেছে আমাদের গায়ে। দি বয় উইথ এ ব্যম্বু হার্টের কিশোরদের মতো আমাদেরও কিছু কিশোরের গায়ে আমেরিকা ও তাদের এক্সটেনশন অঙ্গরাজ্য পাকিস্তান রক্ত লাগাচ্ছে। এই কলামে খুব ক্ষীণ স্বরে বার বার কিন্তু বলে এসেছি, একটি রক্ত আসছে বা চলছে একে ঠেকাতে পারে সুস্থ সংস্কৃতির প্রস্ফুটিত রূপ। আমাদের শিক্ষা ও সামাজিক জীবন ব্যবস্থাপনা থেকে ক্রমেই সংস্কৃতি দূরে চলে যাচ্ছে। আমরা সমাজের নগণ্য অতি, আমাদের কথায় কেউ কান দেয় না। দেয়ার উপায়ও নেই কারণ ক্ষমতায় গেলে তাদের শরীরের উচ্চতা এত বেড়ে যায় যে তাদের কান অবধি সত্য পৌঁছায় না। চার ফুট লম্বা মানুষ তখন বিশ ফুট হয়ে সমাজের ওপর ছড়ি ঘোরায় এবং সে সব ছড়ির আঘাত আমাদের পিঠেও পড়ে। আমরা আমাদের পিঠকে সেভাবে তৈরি করেছি। কারণ জাতিতে ওয়াচ ডগ, তাই যে বাড়ি পাহারা দেই ওই বাড়ির মালিকও আমাদের পেটাবে, তস্করও আমাদের পেটাবে। যা হোক, তার পরেও সুখবর, আমাদের সংস্কৃতিমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মঙ্গলবার বলেছেন, বর্তমান মুহূর্তে সব থেকে প্রয়োজন সংস্কৃতি চর্চা। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের নব্বই শতাংশ বিষয় ভাষণে সীমাবদ্ধ থাকে। কাজ হয় সেটুকুই যেদিন চাষী ‘নিজেই ধান কাটিতে যাইব বলে’ অর্থাৎ পিতার দায়ভার কাঁধে নেয়া প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি নিজেই করবেন তখনই। তার পরেও বলতে হয় এ ব্লাক হোল থেকে মানুষকে মুক্তি দেবে একমাত্র জ্ঞানের চর্চা আর নান্দনিক সংস্কৃতি, কনজুমার সংস্কৃতি নয়। কনজুমার ইকোনমির যুগ থেকে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। এটা বাস্তবতা। তবে মানুষ যাতে ব্যবহারিক জীবনে আর মনোজগতে সমানভাবে উন্নত শিরে বেড়ে উঠতে পারে সেই চিন্তা করতে হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যদি শিল্প বিপ্লবের পাশাপাশি পৃথিবী মনোজাগতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে তাহলে এখন কেন নয়? [email protected]
×