শ্রমিক সংঘ কী? শ্রমিক সংঘের কার্যাবলী আলোচনা কর। শ্রমিক সংঘ কি মুজুরি বাড়াতে পারে?
উ: শ্রমিক সংঘ (ঞৎধফব টহরড়হ): শ্রমিক নিজেদের স্বার্থরক্ষা, আস্থার উন্নতি, চাকুরির, শর্তাবলীর উন্নতি সাধন এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিয়োগকারীর সাথে দরকষাকষিকরে মজুরি বৃদ্ধির জন্য যে স্থায়ী গঠন করে তাকে শ্রমিক সংঘ বলা হয়।
শ্রমিকরা আশা করে অধিক মজুরি। অন্যদিকে মালিকপক্ষ চায় কম মজুরিতে শ্রমিকদের কাজ করতে। শ্রমিক পক্ষ ও মালিকপক্ষের মধ্যে এভাবে সর্বদায় স্বার্থে দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের শোষণ করে। তাই শ্রমিকরা তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সম্মিলিতভাবে শ্রমিক সংঘ গড়ে তোলে। তারা মনে করে একক প্রচেষ্টায় যা সম্ভব নয় শ্রমিক সংঘের মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব।
অর্থনীতিবিদ ব্রিটিশ ও ওয়েব এর মতে,“ শ্রমিক সংঘ হল মজুরিজীবীদের একটি স্থায়ী সংগঠন যার দ্বারা তাদের নিয়োগের অবস্থা সংরক্ষণ বা উন্নত করা যায়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, শ্রমিক সংঘ হল একটি সংগঠন যা দরকষাকষির মাধ্যমে মালিকদের নিকট থেকে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে।
শ্রমিক সংঘের কার্যাবলী: শ্রমিক সংঘের কার্যাবলীকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা Ñ
ক) কল্যাণমূলক বা ভ্রাতৃত্বমূলক কার্যাবলী।
খ) সংগ্রামী কার্যাবলী
গ) রাজনৈতিক কার্যাবলী
ঘ) আপসমূলক কার্যবলী।
ক) কল্যাণমূলক বা ভ্রাতৃত্বমূলক কার্যাবলী (ডবষভধবব ভঁহপঃরড়ঁং): শ্রম সংঘ শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি ও শ্রমিক কল্যাণ সাধনের জন্য যে সব কাজ করে থাকে তাহলো--
১. অর্থনৈতিক সাহায্যে: শ্রমিক সংঘ সকল সদস্যদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে তহবিল গঠনের মাধ্যমে বিপদকালীন সাহায্যে করে থাকে।
২.শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা: শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক সংঘ সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বাস্তবমূখী শিক্ষাও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে।
৩. সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা করে সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।
৪.চিকিৎসা ব্যবস্থা: শ্রমিক সংঘ দরিদ্র ও অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিসায় বিভিন্ন ধরনের সাহায্যে সহায়তা করে থাকে।
৫. ব্যবসায় বিনিয়োগ: বর্তমান কালে শ্রমিক সংঘ সদস্যদের চাঁদায় গঠিত তহবিল থেকে লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এবং লভ্যাংশ শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করে।
৬.আবাসিক সমস্যার সমাধান: বর্তমানে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকগণ শ্রমিক সংঘের মাধ্যমে সদস্যদের আবাসিক সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
৭.চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা বরা: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক ও তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য ক্লাব, পাঠাগার শরীর চর্চা কেন্দ্র, আমোদ-প্রমোদ ও খেলার ব্যবস্থা করে থাকে।
খ. সংগ্রামী কার্যাবলী (গরষরঃধহঃ ঋঁহপঃরড়হং): শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি- দাওয়া আদায়ের জন্য যে সব সংগ্রামী কার্যক্রম করে তা হলো
৮. চাকুরির নিরাপত্ত: মালিকপক্ষ অবৈধভাবে, খেয়াল খুশিমত যাতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে না পারে, সেই ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখে।
৯. চাকুরির শর্তাবলি উন্নত করা: শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা হ্রাস, কারখানার পরিবেশ উন্নয়ন, পেনশন, বোনাস, পদোন্নতি প্রভৃতি অনুকূল দাবি আদায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১০. ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ: আমাদের দেশের মত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ শ্রমের যোগান বেশি হওয়ার মজুরি অত্যন্ত কম হয়। এমতাবস্থায় শ্রমিক সংঘ কর্তৃপক্ষকে মজুরি নির্ধারণে বাধ্য করে।
১১. কাজের সময়সীমা হ্রাস: শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের প্রতিদিনের কাজের ন্যূনতম সময় সীমা কর্তৃপক্ষের কাজ থেকে আদায় করে দেয় এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য মজুরি আদায়ের ব্যবস্থা করে থাকে।
১২. শোষণ ও নির্যাতন বন্ধ: শ্রমিক সংঘ শ্রমিক শোষণ, নির্যাতনবন্ধ, শিশু শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের নির্যাতন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
১৩. বীমা ব্যবস্থা প্রচলন: শ্রমিকদের ঝুঁকি এড়াতে ও শ্রমিকদের নিধাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষকে বীমা প্রথা প্রচলন বাধ্য করে।
১৪. কাজের পরিবেশ উন্নত করা: শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষকে বুঝিয়ে কাজের পরিবেশকে উন্নত করে থাকে।
১৫.ন্যায্য মজুরি: শ্রমিক সংঘ মালিক পক্ষের সাথে দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আদায় করে থাকে।
গ) রাজনৈতিক কার্যাবলী (চড়ষরঃরপধষ ঋঁহপঃরড়হং): শ্রমিক সংঘ শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যাবলীতে অংশ গ্রহণ করে থাকে তা নিচে আলোচনা করা হল:
১৬. আইন প্রণয়: শ্রমিক সংঘ বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি আইন, কারখানা আইন, ক্ষতিপূরণ আইন প্রভৃতি আইন সভার মাধ্যমে পাশ করার চেষ্টা করে।
১৭. দল গঠন: শ্রমিকসংঘ শ্রমিক স্বার্থরক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলগঠন করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চেষ্টা করে।
১৮. আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ: শ্রমিক সংঘ তাদের স্বার্থ কথা বলার জন্য অনেক সময় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আইনসভায় প্রতিনিধি পাঠানো প্রচেষ্টা নেয়।
ঘ) আপসমূলক কার্যাবলি: অনেক সময় শ্রমিক সংঘ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে না পারলে মালিক পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ সুযোগ- সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করে।
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টত যে, শ্রমিক এমন একটি সংঘ যার দ্বারা শ্রমিকরা একতাবদ্ধভাবে মালিকদের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়সহ সার্বিক উন্নয়নে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে শ্রমিক সংঘ যৌক্তিক ভূমিকা পালন করলে শ্রমিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও উন্নতি অর্জিত হবে।
শ্রমিক সংঘ কি মজুরি বৃদ্ধি করতে পারে?
উল্লেখিত প্রশ্নোত্তরে অর্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, শ্রমিক সংঘ কখনই স্থায়ীভাবে মজুরি বাড়াতে পারে না।
কারনগুলো নিম্নরূপ-
ক. মজুরি বৃদ্ধি পেলে দ্রব্যের দাম বাড়বে ফলে চাহিদা কমবে। উৎপাদন হ্রাস পাবে ফলে শ্রমের চাহিদার কমবে ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে।
খ. শ্রমিকের পরিবর্তে মূলধন নিবিড় উৎপাদন পদ্ধতির কারণে শ্রমিকসংঘ মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলন করতে পারবে না।
গ. উৎপাদন খরচের অধিকাংশ অংশ যদি মজুরি বাবদ ব্যয় তবে শ্রমিক সংঘ মুজরি বৃদ্ধির দাবি করতে পারবে না।
আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে শ্রমিক সংঘ নিম্ন লিখিত বিভিন্ন উপায় মজুরি বৃদ্ধি করতে পারে।
১। যৌথ দরকষাকষি: যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতার সমান মজুরি আদায় করতে পারে। সাধারণ প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতাপেক্ষা কম মজুরি মালিকপক্ষ দিয়ে থাকে।
২। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি: শ্রমিক সংঘ শ্রমিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে মুজরি বাড়াতে পারে।
৩। শ্রমিকের যোগান নিয়ন্ত্রণ: শ্রমিক সংঘ কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রমিকের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন-
ক) উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক হলে উৎপাদনকারী দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বেশি মজুরি দিতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে শ্রমের যোগান নিয়ন্ত্রণ করলে মজুরি বৃদ্ধি পায়।
খ) শ্রমিকের মোট মজুরি মোট উৎপাদন ব্যয়ের সামান্য অংশ হলে শ্রমিক সংঘের চাপে মজুরি বাড়াতে পারে।
গ) যদি কোন শ্রমিক শ্রেণি এমন কোন স্বতন্ত্র কাজে দক্ষ হয় যাতে তাদের ছাড়া উৎপাদনকারীর চলে না। সে ক্ষেত্রে শ্রমের যোগান নিয়ন্ত্রণ করতে মজুরি বৃদ্ধি পায়।
ঘ) শ্রমিকদের অন্য শিল্প বা পেশায় চলে যাবার সুযোগ থাকায় শ্রমিক সংঘ শ্রমের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে মজুরি বাড়াতে পারে।
৪। শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি: শ্রমিক সংঘ শ্রমের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে কত্রিম শ্রম সংকট করতে পারে। এতে মালিক পক্ষের চাহিদা বাড়ে ফলে ফলে মজুরি বৃদ্ধি পায়।
ডানপাশে চিত্র প্রযোজ্য
পাশের চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে শ্রমের যোগান সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক ঝখ রেখা ও চাহিদা উখও শ্রমিক সংঘ কৃত্রিম শ্রমের যোগান সংকট তৈরি করায় মালিকের শ্রমের চাহিদা উখও থেকে বেড়ে উখ২ হয় যা মজুরি ঙ১ি থেকে বেড়ে ঙ২ি হয়েছে তা নির্দেশ করে।
সুতরাং বলা যায় যে, শ্রমের যোগান সম্পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক হলে এবং নানা কৌশল ব্যবহার করে শ্রমিক সংঘ মজুরি বাড়াতে পারে।
অধ্যায়-৪
* সুদ কী? সুদের হারের তারতম্যের কারণগুলো কি কি ব্যাখা কর।
উ: সাধারণ অর্থে ব্যক্তির টাকা ধার/ ঋণের দামকে সুদ বলে। কিন্তু অর্থনীতিতে সুদ বলতে আমরা বুঝি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত ঋণ মূলধনের দামকে সুদ বলে।
সুদ (ওহঃবৎবংঃ) : ঋণ গ্রহীতা এক নির্দিষ্ট সময়ান্তে ঋণদাতাকে উৎপাদন কাজে ঋণমূলধন ব্যবহারের জন্য আসলের অতিরিক্ত যে অর্থ প্রদান করে তাকে সুদ বলে।
অর্থনীতিবিদদের সংজ্ঞা:
অধ্যাপক সিনিয়র -এর মতে,“ সুদ হল বর্তমান ভোগ বিরতির পুরস্কার; অধ্যাপক মার্শাল বলেন,“সুদ হল ভবিষ্যত ভোগের জন্য প্রতীক্ষার পুরস্কার।
জে এম কীপস এরমতে ,“ নিদষ্টি সময়ের জন্য তরল অর্থ হাতছাড়া করার পুরস্কার হল সুদ।”
সুতরাং সুদ হল একই সাথে মূলধন ব্যবহারের দাম এবং তারল্য ত্যাগ ও বর্তমান ভোগ বিরতির পুরস্কার।
সুদের হারের তারতম্যের কারণ : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি একই দেশে একই প্রকার ঋণের জন্য এবং বিভিন্ন প্রকার ঋণের জন্য সুদের হার বিভিন্ন হয়ে থাকে। এরূপ হওয়ার কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১. ব্যবহারের ভিন্নতা : যে সব ঋণ অধিক লাভজনক উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয় সেই ঋণের সুদের হার বেশি। পক্ষান্তরে কম উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত ঋণের সুদের হার কম।
২. ঋণের মেয়াদ : ঋণ পরিশোধের মেয়াদ যত বেশি হয় সুদের হার তত বেশি হয়। পক্ষান্তরে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ কম হলে সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম হয়।
৩. ঋণে জামিন : ঋণের জামানত মূল্যবান ও সহজে বিক্রয়যোগ্য হলে সুদের হার কম হয়, বিপরীতভাবে সুদের হার বেশি হয়।
৪. ঋণের পরিমাণ : ঋণের পরিমাণ বেশি হলে সুদের হার কম হয় এবং ঋণের পরিমাণ কম হলে সুদের হার বেশি হয়।
৫. ঋণের উদ্দেশ্য : ঋণ উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহারের জন্য সুদের হার কম হয় এবং ঋণ ভোগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হলে সুদের হার বেশি হয়।
৬. ব্যবস্থাপনা ব্যয় : ঋণ দাবার ব্যবস্থাপনা খরচ বেশি হলে সুদের হার বেশি ও ব্যবস্থাপনা খরচ কম হলে সুদের হার কম হয়।
৭. ঋণগ্রহীতার অবস্থা : ঋণগ্রহীতা আর্থিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাবান হলে সুদের হার কম হয় এবং মর্যাদাবান না হলে সুদের হার বেশি হয়।
৮. ঋণের ঝুঁকি : যেসব ঋণের ঝুঁকি বেশি সে ঋণের সুদের হার বেশি এবং যে ঋণের ঝুঁকি কম সে ঋণের সুদের হার কম হয়।
৯. বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা : বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা বেশি হলে ঋণ মূলধনের সুদের হার বেশি এবং কম হলে সুধের হার কম হয়।
১০. ঋণ দাতাদের প্রতিযোগিতা : ঋণদাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেশি হরে সুদের হার কম হয় এবং প্রতিযোগিতা কম হলে সুদের হার বেশি হয়।
১১. অপূর্ণ প্রতিযোগিতা : ঋণের বাজারে অপূর্ণ প্রতিযোগিতা থাকলে তথা ঋণদাতা ২/১ জন হলে সুদের হার বেশি হয়।
১২. অতিরিক্ত কাজ : ঋণপ্রদানের পর তা আদায়ের জন্য অতিরিক্ত কাজ করতে হলে সেরূপ ঋণের সুদের হার বেশি হয়।
১৩. সরকার আরোপিত কর : সরকারের বিভিন্ন ঋণপত্রের করের পরিমাণ কম বা বেশি হলে সুদের হারও কম-বেশি হয়।
১৪. মূলধনের গতিশীলতা : মূলধন অধিক গতিশীল হলে সুদের হারের মধ্যে তারতম্য হয় না। কিন্তু কম গতিশীল হলে সুদের হারের তারতম্য হয়।
১৫. সরকার গৃহীত আর্থিক ও সুদনীতি : সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অর্থনৈতিক কর্মকা- বাস্তবায়নের জন্য সুদের হার বিভিন্ন করে তাকে।
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় ঋণের প্রকৃতি, ঋণের জামিন, পরিমাণ, ব্যবস্থাপনা খরচ ও সরকারী নীতিমালার প্রভাবে সুদের হারের মধ্যে পার্থক্য/তারতম্য দেখা যায়।
অধ্যায়-০৪
মোট সুদ ও নীট সুদের মধ্যে পার্থক্য লিখ। সুদের হার কি শূন্য হতে পারে?
উত্তর : মোট সুদ : কোন নির্দিষ্ট সময়ান্তে ঋণগ্রহীতাকে ঋণদাতার প্রদেয় ঋণমূলধনের বিপরীতে আসলের অতিরিক্ত যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয় তাকে মোট সুদ বলে।
নীট সুদ : মূলধনের মালিককে নির্দিষ্ট সময়ান্তে শুধুমাত্র মূলধন ব্যবহারের জন্য যে পারিতোষিক দেয়া হয় তাকে নীট সুদ বলে।
উপরের সংজ্ঞা থেকে যেসব পার্থক্য দেখা যায় তা নীচে ছক আকারে দেয়া হল :
পার্থক্যের বিষয় মোট সুদ নীট সুদ
১. সংজ্ঞাগত : ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ান্তে মূলধন ব্যবহারের জন্য মূলধনের মালিককে মোট যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে তাকে মোট সুদ বলে। শুধুমাত্র মূলধন ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময়ান্তে মূলধনের মালিককে যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে তাকে নীট সুদ বলে।
২. উপাদানগত : মোট সুদের উপাদান চারটি। (নীট সুদ + ঝুঁকি গ্রহণের পারিতোষিক + ঋণ ব্যবস্থাপনার পারিতোষিক + ঋণ আদায়ের খরচ বাবদ পারিতোষিক) নীটসুদের উপাদান একটি। শুধু মূলধন ব্যবহারের পারিতোষিক।
৩. পরিধিগত : মোট সুদের পরিধি বিস্তৃত। নীট সুদের পরিধি সংকীর্ণ।
৪. সুদের হারগত : স্থান, কাল, পাত্র ভেদে মোট সুদ ভিন্ন ভিন্ন হয়। স্থান, কাল পাত্রভেদে নীট সুদ একই থাকে।
৫. পরিমাণগত : মোট সুদ পরিমাণে বেশি হয়। নীট সুদ পরিমাণে কম হয়।
৬. নির্ণয়গত : মোট সুদ নির্ণয় করা সহজ। নীট সুদ নির্ণয় করা তুলনামূলক জটিল।
৭. গুরুত্বগত : অর্থনীতিতে মোট সুদের গুরুত্ব কম। অর্থনীতিতে নীট সুদের গুরুত্ব বেশি।
৮. বিশ্লেষণগত : মোট সুদ, সুদের একটি সার্বিক বিশ্লেষণ। নীট সুদ, সুদের একটি আংশিক বিশ্লেষণ।
৯. বিনিয়োগগত : মোট সুদ বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে না। নীট সুদ বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে।
১০. সময়গত : মোট সুদ নির্ণয়ে কম সময় লাগে। নীট সুদ নির্ণয়ে বেশি অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়।
এভাবে মোট সুদ ও নীট সুদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা যায়।
সুদের হার কি শূন্য হতে পারে?
সুদের হার শূন্য হতে পারে কিনা তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে সুদের হার শূন্য হতে পারে। আবার কেহ কেহ মনে করেন যে সুদের হার কখনও শূন্য হতে পারে না। তাত্ত্বিক বিচারে সুদের হার শূন্য হতে পারে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ হতে সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সুদের হার শূন্য হওয়ার কারণ :
১. একটি স্থিতিশীল অর্থনীতিতে ঋণযোগ্য তহবিলের নতুন বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় সুদের হার শূন্য হয়।
২. মূলধন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে থাকলে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা কমতে কমতে শূন্য হয়, ফলে সুদের হার শূন্য হয়।
৩. সমাজে মূলধনের যোগান বৃদ্ধি পেতে থাকলে এমন এক পর্যায়ে আসতে পারে যখন এর চাহিদা অপেক্ষা যোগান বেশি হয়, ফলে সুদের হার শূন্য হয়।
৪. সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন থেকে একে অন্যকে যে ঋণ দেয় তার জন্য কোন সুদ দিতে হয় না।
৫. ধর্মীয় কারণেও বিনা সুদে ঋণ দেয়া নেয়া হয়।
বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে সুদের হার শূন্য না হওয়ার কারণ :
বাস্তব ক্ষেত্রে সুদের হার কমার সম্ভাবনা থাকলেও তা কখনই শূন্যে নেমে আসে না। নিম্নে এর কারণগুরো আলোচনা করা হল :
১. মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা : বাস্তবে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা শূন্যের চেয়ে বেশি থাকে। কারণ উদ্যোক্তা মূলধন উৎপাদনের সে পর্যায় পর্যন্ত নিয়োগ করবে সে পর্যায়ে মূলধনের প্রান্তিক খরচ প্রান্তিক আয়ের সমান হয়। সুতরাং মূলধনের প্রান্তিক খরচ বা সুদ কখনও শূন্য হয় না।
২. গতিশীল অর্থনৈতিক শক্তি : আয় বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন চাহিদা বৃদ্ধি প্রভৃতি গতিশীল শক্তি কাজ করে যার ফলে মূলধনের চাহিদা শূন্য হতে পারে না। ফলে সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
৩. সঞ্চয়ে আকৃষ্ট করা : সুদের হার শূন্য না হলে বা বাড়ালে বোগ ব্যয় হ্রাস কর জনগণ সঞ্জয় উৎসাহিত হয়। ফলে সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
৪. নগদ অর্থ হাতছাড়া করা : মানুষ ভবিষ্যতের যে বিপদের কথা চিন্তা করে নগদ অর্থ হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু ঋণ দিলে নগদ অর্থ হাতছাড়া হয়। সুতরাং মানুষকে নগদ অর্থ হাতছাড়া করতে হলে যে সুদ দিতে হয় তা অবশ্যই শূন্যের চেয়ে বেশি।
৫. বর্তমান ভোগ বিরতির পুরস্কার : অধ্যাপক কেইন্স বলেন দীর্ঘকাল আমরা সবাই মৃত। তাই মানুষ সব সময়ই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা বর্তমান ভোগের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় বর্তমান ভোগ বিসর্জন এবং সঞ্জয় উৎসাহিত করার জন্য সঞ্চয়কারীকে যে সুদ দিতে হয় তা অবশ্যই শূন্যের চেয়ে বেশি হতে পারে।
৬. নগদ পছন্দের ফলে : বাস্তবে মানুষ সর্বদা লেনদেন চাহিদা ও সতর্কতামূলক চাহিদার জন্য নগদ পছন্দ করে। এজন্য সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
অধ্যাপক কেইন্সের মতে, ‘সুদের হার কমতে কমতে এমন স্তরে আসে যেখানে জনগণের নগদ পছন্দ অসীম স্থিতিস্থাপক হয়। সুদের হার ঐ স্তরের নীচে নামতে পারে না। এ স্তরের তারল্য ফাঁদের সৃষ্টি হয়। ফলে সুদের হার শূন্য হতে পারে না।
ডান পাশে চিত্র প্রযোজ্য
চিত্রে ভূমি অনেক নগদ অর্থের চাহিদা এবং লম্ব অনেক সুদের হার দেখানো হয়েছে। সুদের হার ঙজ থেকে কমে ঙজ, এবং ঙজ২ হওয়ায় নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে ঙখ১ এবং ঙখ২ হয়েছে। ঙজ২ সুদের হারে নগদ অর্থের চাহিদা অসীম যা খচ রেখার ধ বিন্দুর পরবর্তী অংশ দ্বারা দেখানো হয়েছে।
অধ্যাপক কেইন্সের মতে, ঙজ২ সুদের হারই হচ্ছে তারল্য ফাঁদের সুদের হার যা কখনও আর হ্রাস পাবে না। এজন্য সুদের হার কখনও শূন্য হতে পারে না।