ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

নাগাসাকি থেকে রূপপুর

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১০ আগস্ট ২০১৬

নাগাসাকি থেকে রূপপুর

টোকিও শহর প্রান্তে বাস করতেন প্রফেসর য়োসিও নিশিনা। এক সময় কাজ করতেন বিজ্ঞান ভিক্ষু নীলস বোরের সঙ্গে। নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী অটোহানেরও বন্ধু তিনি। জাপানের সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ। হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পরদিন- সাত আগস্ট। সকাল নয়টার সময় একটি মিলিটারি জীপ এসে থামল প্রফেসর নিশিনার বাসার সামনে। নিশিনা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। মিলিটারি অফিসারটি প্রফেসরকে বললেন- স্যার গতকাল থেকে আমরা রেডিও বা টেলিফোনে হিরোশিমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। অবশ্য আমরা খবর পেয়েছি সেখানে নাকি একটা মাত্র বোমা পড়েছে। একটি মাত্র বোমায় কি এমন হলো, এ কথা বলে নিশিনাকে তাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলেন। এর মধ্যে একজন সাংবাদিক এসে বললেন, এই মাত্র আমেরিকান ব্রডকাস্টিং থেকে বলা হচ্ছে হিরোশিমায় নাকি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু সামরিক অফিসার তা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটি মিথ্যা প্রচার। নিশিনা বললেন, হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পরমাণু বোমার ভয়াবহতা সম্পর্কে নিশিনা সম্যক জানতেন। কিন্তু বাস্তবে যা দেখলেন তা জানার চেয়েও ভয়ঙ্কর। মনে সাহস নিয়ে ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন করলেন। হিরোশিমার যে স্থানের ওপর বোমাটি পড়েছিল, বিপদের কথা না ভেবে নিশিনা মাটি খুঁড়ে রেডিও-এ্যাকটিভিটির পরিমাণ পরীক্ষা করলেন। ফিরে এসে তিনি নির্ণয় করলেন কত উঁচুতে বোমাটা ফোটানো হয়েছিল, তাপমাত্রা কত উঠেছিল, বায়ুর বেগ কত ছিল, কতটা টিএনটি বোমার বিস্ফোরণের সমতুল্য শক্তি ছিল। পরে হিসেব কষে দেখা গিয়েছিল প্রফেসর নিশিনার এই প্রাথমিক হিসেব শতকরা ৯৭ ভাগ সঠিক ছিল। মিলিটারি অফিসার নিশিনাকে বাড়ি যেতে না দিয়ে নিয়ে গেলেন টোকিওর সেনাসদরে। সেখানে একদল সেনাকর্তা নিশিনার কাছে জানতে চাইলেন, প্রফেসর আমরা ছয় মাসের মধ্যে পারমাণবিক বোমা বানাতে পারব কি? নিশিনা বললেন, ছয় মাস কেন, ছয় বছরেও নয়। আর একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, জাপানে ইউরেনিয়াম আদৌ নেই। সেনা কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে এমন বোমা বানাতে পারলে অন্তত ছয় মাস যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখা যাবে আর প্রতিশোধও নেয়া যাবে। কিন্তু নিশিনার কথায় তারা হতাশ হলেন এবং জানতে চাইলেন, তা হলে আমাদের কি কিছুই করার নেই? নিশিনা শুধু একটি কথাই বললেন, জাপানের আকাশে কোন মার্কিন বিমান দেখলেই তাকে ভূপাতিত করতে হবে। হায়রে বিধি! সেনা কর্মকর্তাদের প্রতিশোধ নেয়া তো দূরের কথা, জাপানীরা কান্নারও সময় পাননি। ৬ আগস্টের মধ্যখানে মাত্র দুই দিন ৯ আগস্ট, ১৯৪৫। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো জাপানের নাগাসাকিতে। ধ্বংসের পরিমাণ একই রকম। কেবল বোমাটি ইউরেনিয়াম পরমাণু নয়, প্লুটোনিয়াম পরমাণু। নাম ‘ফ্যাটম্যান’। নাগাসাকি শহরের পত্তন ঘটে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে। ১৫৪৩ সালে পর্তুগীজরা প্রথম এখানে আসে। ১৮৫৯ সালে নাগাসাকিকে উন্মুক্ত বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বন্দরনগরী নাগাসাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয়। যুদ্ধের অধিকাংশ সরঞ্জাম তৈরি হতো এখানে। মূলত ৯ আগস্ট পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নাগাসাকি ছিল এক প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ও কর্মমুখর জনপদ। কিন্তু ফ্যাটম্যান নিক্ষেপের ফলে নাগাসাকি পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। যেখানে মৃত্যুই ছিল সত্য। বস্তুত হিরোশিমা ও নাগাসাকির ভয়াবহতায় বিজ্ঞানীরা হতাশ হলেও দমে যাননি। অফুরন্ত শক্তির উৎস ‘পরমাণু’কে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারে আত্মনিয়োগ করেন। মূলত এর অনিবার্য পরিণতিতে ১৯৫১ সালের ২০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষামূলক ব্রিডার রি-এ্যাক্টর দিয়ে প্রথমবারের মতো চারটি বাল্ব জ্বালিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২৬ জুন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এপিএস-১ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট উৎপাদিত ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়ার গ্রিডে যুক্ত করেছিল। এদিকে ১৯৫৬ সালের ২৭ আগস্ট যুক্তরাজ্য ক্যালডার হলো ১ নামে ৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট চালু করেছিল। বস্তুত এভাবেই নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের যাত্রা শুরু তথা শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের সূচনা। বর্তমান পৃথিবীর ৩১টি দেশে ৪৩৮টি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুত বিশ্বের মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১৪ শতাংশ। যার পরিমাণ ৩৭৯ গিগাওয়াট। ১৫টি দেশে আরও ৭২টি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ ৪৫টি দেশে ১৬৮টি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রই নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশসমূহ- যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বস্তুত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহার তথা নিউক্লিয়ার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। ১৯৪৫ থেকে ২০১৬ সময়ের হিসেবে ৭১ বছর। এতদিন পরও হিরোশিমা ও নাগাসাকির ভয়াবহতা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। না জানি পরাশক্তিগুলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানে অনিবার্যভাবে নিউক্লিয়ার ওয়ার। মানুষের এই আশঙ্কা আরও বদ্ধমূল হয় এই কারণে যে, বর্তমান বিশ্বের রুশ ফেডারেশনের ৪ হাজার ৭শ’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪ হাজার ৫শ’, ফ্রান্সে ৩শ’, চীনে ২শ’ ষাট, যুক্তরাজ্যে ২শ’ পনেরো, ইসরাইলে ষাট, পাকিস্তানে ১শ’ বিশ, ভারতে ১শ’ দশ ও উত্তর কোরিয়া ১০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। বিশ্বের সামরিক শক্তিধর দেশেগুলোতে পারমাণবিক বোমার এই বিশাল মজুদ শান্তিকামী ও যুদ্ধবিরোধী মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। আনন্দের সংবাদ হলো, পারমাণবিক বোমা থেকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন। একদিন আমরা গোটা শহরকে উড়িয়ে দেয়ার জন্য যে বোমা বানিয়েছিলাম, আজ সেই বোমা দিয়েই আলোকিত করতে পারব পুরো শহরসহ অসংখ্য জনপদ। এর বাস্তব প্রয়োগ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দশ বছর ধরে রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক ওয়ারহেড কিনে আসছে, যা থেকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। তাই পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার পৃথিবীর পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনছে। এ এক শুভ সূচনা। বাংলাদেশও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই শুভ সূচনার অংশী হতে যাচ্ছে। বস্তুত হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে পারমাণবিক শক্তির যে প্রকাশ ঘটেছে তা এখন উন্নত ও সমৃদ্ধ পৃথিবী বিনির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও নির্মাতা
×