ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১০ আগস্ট ২০১৬

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সঙ্কট

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকায় পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্ম সমাজের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাহ্ম স্কুল। সেই ব্রাহ্মস্কুল থেকে দেড় শতকের রূপান্তরের ইতিহাস পেরিয়ে ২০০৫ সালে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করে। একটি পাঠশালা হিসেবে যাত্রা শুরু করে দেড় শতকের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর অগ্রযাত্রার ইতিহাস বড়ই রোমাঞ্চকর। প্রতিষ্ঠার দেড় দশকের মধ্যেই আর্থিক সঙ্কটের দরুন স্কুলের মালিকানা পরিবর্তন হয়। এর ফলে মালিকের বাবার নামানুসারে ব্রাহ্ম স্কুলের নতুন নাম হয় জগন্নাথ স্কুল। কিছুদিনের মধ্যেই কর্তৃপক্ষ স্কুলটিকে কলেজে রূপান্তর করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের কোষাধ্যক্ষ গিরিশ চন্দ্র নাগ লিখেছেন, ‘গরিব ও পশ্চাৎপদ জনসংখ্যার হাতের নাগালের মধ্যে বিদ্যাকে এনে দিয়ে জগন্নাথ কলেজ পূর্ব বাংলায় সৃষ্টি করেছিল সামাজিক বিপ্লবের।’ ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ জগন্নাথ কলেজ প্রাঙ্গণে বক্তৃতা দেয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর পূর্ববঙ্গ সফর শুরু করেছিলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ১৯২৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ কলেজে বক্তৃতা করেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে জগন্নাথ কলেজ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে। এই সময় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জগন্নাথ কলেজে আসেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এই কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের ছিল জোরালো ভূমিকা। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ নিজেই ছিলেন অনেক বড় বিপ্লবী। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রফিক এই কলেজের ছাত্র। এই কলেজের শিক্ষক অজিত গুহ, মুনীর চৌধুরী, নেয়ামল বাসির রাষ্ট্রভাষার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর সরকারবিরোধী প্রথম প্রতিবাদটি জানিয়েছিল জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজের অবদান ছিল অপরিসীম। ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশের এক দশকের মধ্যেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের আত্মজীবনী আমার সাত দশকে জগন্নাথ কলেজ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শুরু থেকে অদ্যাবধি যত প্রধান ও সৎ আন্দোলন হয়েছে তার অধিকাংশই শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জগন্নাথ কলেজ থেকে।’ অবকাঠামোগত কোন সুযোগ সুবিধা না থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করার মাত্র এক দশকের মধ্যে জগন্নাথের এই অবস্থানের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এর ভৌগোলিক অবস্থান।’ শুধু ঢাকা শহরে অবস্থানের কারণে নানামুখী সমস্যার পরও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে। এটি দেশের একমাত্র অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপ আমেরিকায় খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও আমাদের এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা থাকবে না এটা ভাবা যায় না। ফলে আবাসিক সুবিধার দাবিতে প্রায়শ উত্তাল হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমত প্রশ্ন, জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল চাওয়ার দাবি কতটা যৌক্তিক? বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় কলেজে আবাসিক সুবিধা রয়েছে। ঢাকার ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা, তিতুমীর, ঢাকা কলেজÑ সবার রয়েছে একাধিক আবাসিক হল। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় আবাসিক কলেজগুলোর একটি ছিল তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ। যার ১২টি আবাসিক হল ছিল। ফলে অতীত ইতিহাস, অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক সুবিধা শিক্ষার্থীদের প্রায়শ উত্তেজিত করে। ২০১৪ সালে এই দাবি বেশ জোরালো আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের সঙ্গে সমঝোতা করে সেই যৌক্তিক আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়। বর্তমানে ঢাকা শহরে চলমান জঙ্গীবিরোধী অভিযানের ফলে ব্যাচেলর মেসগুলোতে ছাত্রদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। নিরাপত্তা ও পুলিশী হয়রানির কারণে কেউ ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দিচ্ছে না। ফলে নিরুপায় হয়ে আবার রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের এই দাবিকে আপনি কীভাবে অযৌক্তিক বলবেন। দ্বিতীয়ত, আপনি যদি ধরে নেন এটা যৌক্তিক দাবি, তাহলে সেই দাবি কিভাবে পূরণ করবেন? প্রাক্তন জগন্নাথ কলেজের বেদখলকৃত হলগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দেয়া যায়। সেগুলোতে শিক্ষার্থীদের নতুন করে আবাসিক সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। তবে দীর্ঘদিন ধরে নানা মহলের হাতে থাকা এই হলগুলো পুনরায় দখল করা, আবাসনের উপযোগী করা বেশ দুরূহ বিষয়। তাই আবাসিক সঙ্কট মোচনে সরকার ও কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ভাবতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আশপাশে দুটি বহুতল ভবন নির্মাণ করে আপাতত আবাসিক সঙ্কট দূর করা যায়। তৃতীয়ত, বর্তমানে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা পুরনো জেলখানার জায়গায় হল নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে। সেটা কতটা যৌক্তিক? পুরনো কারাগার স্থানান্তরের পর খালি জায়গায় চাইলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার দিতে পারে না। এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। শুরুতে অনেকের অজানা একটি বিষয়ের অবতারণা করছি। আরও প্রায় ৬ মাস আগে পুরনো জেলখানার খালি জায়গায় কি করা যায় তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভেবে নির্ধারণ করে রেখেছেন। তার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ঢাকা বিশেষজ্ঞ, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতির সমন্বয়ে করে দিয়েছেন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। সুতরাং এটা স্পষ্ট, কারাগারের জায়গায় হল নির্মাণের জন্য প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি। কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীরা যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কনভিন্স করতে পারেন তবেই কেবল তাদের দাবি আদায় সম্ভব। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে কারাগারে না হোক অন্তত অন্য কোথাও আমাদের প্রিয় সন্তানদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খুব মজার একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। প্রশাসনের সঙ্গে যখনই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কোন বিষয়ে ঝামেলা হয়। তখনই হল চাই আন্দোলন বেগবান হয়। প্রশাসন প্রেশারে পড়ে যায়। উপাচার্য ছাত্র নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় যায়। ছাত্র নেতারা কর্মীদের সরিয়ে দেয়। দুদিন আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে যারা রাজপথে টায়ার জ্বালিয়ে হল চাই হল চাই গলা ফাটিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সঙ্কট নিরসনের যে দাবি সেটা শতভাগ যৌক্তিক। এর জন্য মূল উদ্যোগটা নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। প্রশাসন আন্তরিক হলে হল নির্মাণ কোন বিষয় নয়। তবে শিক্ষার্থীদেরও বুঝতে হবে, এটি কলেজ কাঠামোয় গড়ে ওঠা একটি বিশ্ববিদ্যালয়। রাতারাতি কোন কিছু সম্ভব নয়। তবে প্রশাসনের উচিত দৃশ্যমান কিছু করা। শুধু বড় বড় স্বপ্নে গল্প শুনতে শুনতে সবাই ক্লান্ত। এখন চাই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে এই আন্দোলনকে আর দমানো যাবে না। হয়ত সাময়িকভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবার ক্লাসে ফিরে যাবে। প্রশাসনের উচিত হবে নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। কারাগারের জমি দীর্ঘমেয়াদী লিজের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়া। শোকের এই মাসে বঙ্গবন্ধু কন্যা তার এই সন্তানদের যাতনা অবশ্যই অনুভব করতে পারবেন আশা করি। লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
×