ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

ধর্মীয় আবরণের আড়ালে

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১০ আগস্ট ২০১৬

ধর্মীয় আবরণের আড়ালে

ইস্তানবুলের ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মীয় নেতারা এক সঙ্গে বসে নাকি একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা হলো, ওই শহরের বিখ্যাত হাজিয়া সোফিয়া মসজিদটি নতুন করে নির্মাণ করে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ তাতে নিজ ধর্মের উপাসনা করবেন। শুক্রবার মুসলমানরা জুমার নামাজ পড়বেন, রবিবার খ্রীস্টানরা তাদের প্রার্থনা সারবেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকেও নাকি এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পবিত্র শহর নজসে হযরত আলীর মাজারে শিয়া ধর্ম গুরুরা এবং খ্রীস্টান বিশপ এক সঙ্গে ধর্মালোচনায় অংশ নিচ্ছেন। ওদিকে কাছেই কুফা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডিন ধর্মবিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন যেখানে সব ধর্মমত নিয়ে আলোচনা হয়। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিতে পারেন যে কোন ধর্মাবলম্বীরা। সোমবার একটি দৈনিকে নিয়মিত কলামে সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার বই আলোচক জনাথন স্টিল এর একটি বই আলোচনার উল্লেখ করে বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলেছেন। বইয়ের নাম ‘হলি ল্যান্ডস : রিভাইভিং প্লুরালিজম ইন দ্য মিডলইস্ট।’ লেখক নিকোলাস পেলহাম। দেশের এবং বিশ্বের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে মুসলমান এবং খ্রীস্টান বা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক মতবিনিময় বা এক সঙ্গে বসাকে আপাতদৃষ্টিতে বড় কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু এই ধর্মালোচনা বা ধর্ম সম্মিলনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ বিষয়টি ধর্মীয় নয় শতভাগ রাজনৈতিক। আর ইস্তানবুলের যে মসজিদটির কথা বলা হয়েছে তার রয়েছে চৌদ্দ শ’ বছরের ইতিহাস। হাজিয়া সোফিয়া এখন আর মসজিদ নয়, জাদুঘর। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শ’ সাঁইত্রিশ সালে সম্রাট জাস্টিয়ান-১ এর সময় এটা নির্মিত হয়েছিল গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে। তারপর বহুবার সংস্কার, অলঙ্করণ; পরিবর্ধনে রূপ নেয় ক্যাথিড্রালের। চৌদ্দ শ’ তেপ্পান্ন সালে অটোম্যান সম্রাট সুলতান মেহমেদ-২ ইস্তানবুল জয় করার পর এটি মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং এর সৌন্দর্য আরও বাড়ান। সুলতান মেহমেদের পরের সুলতানরাও সংস্কার কারুকার্যে এর সৌন্দর্য আরও বিকশিত করেন। এরপর তুর্কী রিপাবলিকের সময় উনিশ শ’ একত্রিশ থেকে চার বছর বন্ধ থাকার পর উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সালে ‘ওয়াল্ড ইউনিক আর্কিটেকচারাল মনুমেন্ট এবং মিউজিয়াম’ হিসেবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখনও তাই আছে। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে আবার উপাসনালয়ে পরিণত করার চেষ্টা ধর্মীয় কূপম-ূকতাকেই সমর্থন করে, যা এখনকার মৌলবাদী তুরস্কের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। আসলে সারা পৃথিবীতে এখন যা ঘটছে একে ধর্মীয় আবরণ দেয়ার চেষ্টাও এক সুনিপুণ পরিকল্পনার অংশ। যাতে বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি এতে আচ্ছন্ন থাকে। আচ্ছন্নতা কাটিয়ে পরিষ্কার বুঝতে হবে দ্বন্দ্বটা ইসলাম বনাম খ্রীস্টান নয়, দখল ও আধিপত্যের। অস্ত্র ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যের সম্পদ জোর করে ভোগ করার। চালাকিটা হচ্ছে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশগুলোকে তছনছ করে সেখানকার জনজীবন বিপন্ন করে যারা এসব করছে সাধারণভাবে তারা বর্বর হিসেবে চিহ্নিত হয় না। বরং যারা একে প্রতিরোধ এবং আত্মরক্ষার চেষ্টা করে তারাই বর্বর হিসেবে চিহ্নিত হয়। পৃথিবীর ভূ-ভাগ দখলের সেই যুগে খ্রীস্টান বনাম মুসলমানের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল তাও আসলে আধিপত্য বিস্তারেরই লড়াই। যদিও তা এখনকার মতো এমন বিধ্বংসী ছিল না। ভেনিস যখন ইউরোপীয় সভ্যতার কেন্দ্রে ছিল সে সময় অটোম্যানরা ছিল তাদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক। তখনকার জানা পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জয় করেছিল অটোম্যানরা। ষোলো শ’ তিন সালের মধ্যে তারা গোটা পূর্ব-ইউরোপ দখল করেছিল। ভেনিসের পরিচিতি ছিল খ্রীস্টান রাষ্ট্র হিসেবে। অটোম্যানদের বিজয়াভিযান তাদের চোখে ছিল মুসলমানদের বিজয়াভিযান। নিজেদের তারা ভাবত সভ্য আর মুসলমানদের আখ্যা দিয়েছিল ‘বর্বর’ বলে। হয়ত যুদ্ধ আর বীরত্বে তাদের সমান হতে না পারার ব্যর্থতা বোধ থেকে। যেমন শেকসপীয়র এবং তার সময়কার ইংরেজরা ঈর্ষান্বিত ছিলেন ভেনিসের প্রতি। লন্ডনকে তারা ভেনিসের মতো আধুনিক শহর ভাবতে চাইতেন। কিন্তু বাস্তবে সে সময়ের লন্ডন তা ছিল না। এই ব্যর্থতার ক্ষোভ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা সুলভ মনোভাব থেকে ভেনিসকে তারা ইউরোপের অন্যতম আধুনিক নগরী বলে স্বীকার করার পাশাপাশি অন্যতম ‘গনিকালয়’ও বলতেন। পনের শ’ বাহাত্তর সালে অটোম্যানরা ভেনিসের কর্তৃত্ব থেকে সাইপ্রাস দখল করলে ভেনিসীয়রা আরও ভীত হয়ে পড়ে এবং মুসলমানদের আরও তীব্রভাবে বর্বর অসভ্য ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করে। অটোম্যানরা অনেক সময়ই দুর্ধর্ষ ছিলেন কিন্তু দয়া ও ন্যায়পরণতার জন্য তাদের সুনামও ছিল। উদারতা এবং ন্যায় পরায়ণতার জন্য সুলতান সুলেমান ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন। আজকের ইউরোপেও তিনি ‘সুলেমান : দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে সম্মানিত। সুতরাং খ্রিস্টান বনাম মুসলমানের দ্বন্দ্ব বলে পরিচিত হলেও সে সময়ে অটোম্যানদের সাম্রাজ্যই বিস্তারই ছিল ভেতরের কারণ। ॥ দুই ॥ দখল-আধিপত্যের লড়াই শুরু থেকেই ক্ষমতাবানদের মধ্যে। ক্ষমতাহীনরা যুদ্ধের কুফল ভোগ করেছে শুধু। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকেই পুরো দুনিয়া কয়েকটি দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। বিশ শতকের শুরুতে ভাগ বা দখল করার জন্য আর কোন ভূখ- বাকি ছিল না। তখন অনিবার্য হয়ে পড়ে পুনর্বণ্টন। অর্থাৎ উপনিবেশের দখল এক প্রভুর কাছ থেকে অন্য প্রভুর কাছে যাওয়া। এ থেকে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত পৃথিবীবাসীকে যুদ্ধের মুখোমুখি করে। আঠার শ’ ষাট থেকে আঠার শ’ আশি সাল ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ দখলের স্বর্ণযুগ। আঠারো শ’ ছিয়াত্তর সালে ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোর মোট আয়তন ছিল চার কোটি বর্গকিলোমিটার। যেখানে মোট জনসংখা ছিল সাতাশ দশমিক আটত্রিশ কোটি। উনিশ শ’ চোদ্দ সালে এ পরিসংখ্যান দাঁড়ায় যথাক্রমে ছয় পয়েন্ট পনেরো কোটি বর্গকিলোমিটার এবং আটচল্লিশ দশমিক বাইশ কোটি। আঠারো শ’ তিয়াত্তর সালে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের কোন উপনিবেশ ছিল না। উনিশ শ’ চৌদ্দ সালে পৌঁছে এ তিন রাষ্ট্রের উপনিবেশের আয়তন দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশ লাখ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা চার দশমিক বারো কোটি। বেশিরভাগ উপনিবেশ ছিল ব্রিটেনের দখলে। শিল্প বিপ্লব পেরিয়ে আসা ব্রিটেনের অর্থনৈতিক শক্তিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো পাল্টা শক্তি তখনও ছিল না। ভারত, বর্মা, মালয়, আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অর্ধেকের বেশি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ আরও কিছু অঞ্চলের দখল নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন জ্বল জ্বল করছে। দখলদারিত্বে এরপরের অবস্থান ছিল ফ্রান্সের। তার দখলে ছিল উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা, মাদাগাস্কার, ভিয়েতনাম এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপ। জার্মানি অধিকার করেছিল পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়ার কিছু অঞ্চল। সাইবেরিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখলে নিয়েছিল কিউবা, পোর্টেরিকো এবং হাওয়াই। ইতালি, জাপান, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের দখলেও ছিল কিছু এলাকা। মূলত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইন্দোনেশিয়ার দখল ছিল নেদারল্যান্ডসের হাতে। আঠারো শ’ ছিয়াত্তর সালের পর ছ’টি রাষ্ট্রের উপনিবেশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। রাষ্ট্রগুলো হলো ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। এদের উপনিবেশের মোট আয়তন হয়েছিল দুই পয়েন্ট পাঁচ কোটি বর্গকিলোমিটার, যা প্রভুদেশগুলোর আয়তনের প্রায় দেড় গুণ। আর এর জনসংখ্যা ছিল প্রভুদেশগুলোর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ষাট ভাগ। বিশ শতকের শুরুতে আফ্রিকা ও এশিয়ার অল্প কয়েকটা দেশ যেমন লাইবেরিয়া, আবিসিনিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও পারস্য স্বাধীন থাকলেও কোন না কোন সাম্রাজ্যের প্রভাব বলয়ে ছিল। দখলের এ পুরো প্রক্রিয়া কোন না কোন আবরণের আড়ালেই হয়েছে।
×