ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুর- প্রত্যেকটিতে জড়িত তামিম চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৯ আগস্ট ২০১৬

হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুর- প্রত্যেকটিতে জড়িত তামিম চৌধুরী

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানা প্রত্যেকটি ঘটনায় (কমন) অংশগ্রহণ ছিল জঙ্গী মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীর। প্রতিটি ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, বিদেশী নাগরিক, ধর্মযাজক, পুরোহিতসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা ও হামলার ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হক জিয়া। গুলশানের জঙ্গী হামলাকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ভিডিও চিত্র, মোবাইল ফোনসেট থেকে উইকার ও থ্রিমা নামক এ্যাপসের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞের ছবি ও ভিডিওচিত্র জঙ্গী সংগঠন আইএস-এর মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির কাছে পাঠানোর বিষয়গুলোর তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মাস্টারমাইন্ড পরিচিত হাসনাত রেজা করিম ও কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাহমিদ হাসিব খান। এর মধ্যে কানাডিয়ান নাগরিক তামিম, কানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তাহমিদ ও ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী হাসনাত রেজা করিম-এই তিন জনের আন্তঃদেশীয় জঙ্গী কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় অংশ নেয়া ৫ জঙ্গীর সঙ্গে হেঁটে অনতিদূরের পয়েন্ট পর্যন্ত এসে তাদের সাফল্য কামনা করে বিদায় নিয়েছিল জঙ্গী নেতা তামিম চৌধুরী। একইভাবে শোলাকিয়ায় হামলার দিনও সঙ্গী জঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে সব বুঝিয়ে সরে পড়ে তামিম। আর কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় নিয়মিত তামিম চৌধুরীর যে যোগাযোগ ছিল তা স্টর্ম-২৬ অভিযানের সময়ে আহত অবস্থায় ধরা পড়া জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানের দেয়া জবানবন্দীতেই তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এতেই দেখা যাচ্ছে গুলশান, কল্যাণপুর ও শোলাকিয়ার তিনটি জঙ্গী কা-ের প্রত্যেকটিতেই (কমন) সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তামিম আহমেদ চৌধুরীর। এমনকি তার গুলশান হামলার আগে বসুন্ধরা এলাকার ই-ব্লকের ৬ নম্বর রোডের একটি বাসায় লুকিয়েছিল এবং এখানেই গোপন বৈঠকে মিলিত হওয়ার মতো তথ্য উঠে আসছে অনুসন্ধানে। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিন কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে হামলার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিতে সঙ্গী জঙ্গীদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিল তামিম। হামলার আধাঘণ্টা আগে সে সব কিছু ব্রিফ করে কিশোরগঞ্জ ত্যাগ করে বলে জানতে পেরেছেন বলে এমন তথ্য পেয়েছেন র‌্যাবের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত বাংলাদেশ সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীকে গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন বলে চিহ্নিত করে গোয়েন্দারা। কল্যাণপুরে জঙ্গীদের গোপন ডেরায় বৈঠক ও সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য তাদের উজ্জীবিত এবং আর্থিক সহায়তা দিতেন বলে যে তথ্য পাওয়া গেছে তারও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এই ধরনের তথ্য পাওয়ার ভিত্তিতেই তামিম চৌধুরীর উপর সব প্রধান্য দিয়ে তদন্ত কাজ এগোচ্ছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে তামিম ও বহিষ্কৃর মেজর জিয়াউল হককে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা ঘোষণা করেছে পুলিশ। তামিম ও জিয়া দেশেই থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, মেজর জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) সমন্বয়কের কাজ করেছে। ২০১২ সালে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টায় চাকরি হারান মেজর জিয়া। এই ঘটনার পেছনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। চাকরি হারানোর পর থেকেই তিনি এবিটির সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব নেন। সামরিক প্রশিক্ষণ দেন দু’শতাধিক সদস্যকে। পরবর্তীতে এই প্রশিক্ষিত সদস্যদের মাধ্যমে লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, ধর্মযাজক, পুরোহিত ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী-মতাবলম্বীদের হত্যার টার্গেট সেট করে কিলিং মিশন পরিচালনা করেন, এমন তথ্যও পেয়েছে গোয়েন্দারা। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সামরিক শাখা প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মেজর জিয়ার জেএমবি সংশ্লিষ্টতা ও জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) অর্থায়ন বিদেশ থেকেই হয় এমন ধরনের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, গুলশান হামলায় নেপথ্যের মূলে জড়িতদের শনাক্ত করার দাবি করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। হাসনাত করিম ও তাহমিদ হাসিবের সঙ্গে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলাকারী জঙ্গীদের সঙ্গে অন্তত ১০টি ছবি রয়েছে যাতে অন্তরঙ্গভাবে আছেন, কথা বলছেন, অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, ছাদে হাঁটছেনÑ এই ধরনের ছবিগুলো এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে সামনে চলে এসেছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ থাকার পর এ দু’জনকে গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ৫৪ ধারায় আদালতে হাজির করে ৮ দিনের রিমান্ড এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত গুলশান জঙ্গী হামলার মামলায় কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলে আসছেন, হামলার মূল পরিকল্পনাকারী, সমন্বয়ক, অর্থদাতাসহ জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, রিমান্ড শেষে বিস্তারিত বলা যাবে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে আটক রিগ্যান জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, রাজধানীর কল্যাণপুর, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গীরা সুইসাইড স্কোয়াডের ও সিøপার সেল পদ্ধতিতে কার্যক্রম চালায়। শোলাকিয়ায় আটক জঙ্গী শাফিউল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে তদন্তকারীরা। দুই জঙ্গীই আহত অবস্থায় ধরা পড়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা এই দুই জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। আটক হওয়া চিকিৎসাধীন দুই জন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের জঙ্গীরা একই সূত্রে গাঁথা। কমান্ডসেন্টার থেকে তাদের প্রত্যেককে ছদ্মনাম দিয়ে এ্যাকশনে নামায় (হত্যাকা- ও নাশকতায়) মাস্টারমাইন্ড, যা তারা চেহারা দেখলে চিনবে কিন্তু সঠিক নাম পরিচয় অজানা। পলাতক শীর্ষস্থানীয় এসব জঙ্গীরা যাতে বড় ধরনের নাশকতা বা হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটাতে না পারে সেজন্য পর তাদের গ্রেফতারের জন্য মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।
×