ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিপুল নোট ও সরঞ্জাম উদ্ধার

রাজধানীতে জালনোট চক্রের ৯ বিদেশীসহ দশজন গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৯ আগস্ট ২০১৬

রাজধানীতে জালনোট চক্রের ৯ বিদেশীসহ দশজন গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে তিন দফায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক জালনোট তৈরি ও বাজারজাতকরণ চক্রের নয় বিদেশী সদস্যসহ দশ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ জালনোট ও জালনোট তৈরির নানা সরঞ্জাম। রবিবার বিকেলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এর একটি দল রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অভিযান শুরু করে। অভিযানে বি ব্লকের ১০ নম্বর সড়ক থেকে গ্রেফতার হয় বিদেশী নাগরিক আবদু নাসারা (৩৫), জিন ক্লাউডি (৪০) ও তাদের বাংলাদেশী সহযোগী নারী সদস্য মেরী ময়না পরী টেলর (২৬)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ জাল বৈদেশিক নোট, বিভিন্ন প্রকার জালনোট তৈরির রাসায়নিক পদার্থ ও সরঞ্জাম। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এ ব্লকের ২ নম্বর সড়ক থেকে গ্রেফতার করা হয় তিন বিদেশী নাগরিক গুনো ডেসায়ার (৩৭), ক্যামবিওয়া দিও নিডার্ট (৪৩) ও তাইদিও বার্নাডকে (৩৪)। এদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এফ ব্লকের ২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে আরেক বিদেশী মগুয়াম সলোকে (৪২) গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকেও উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী জালনোট, জালনোট তৈরির রাসায়নিক পদার্থ ও মারাত্মক নেশার বেশ কিছু ইয়াবা ট্যাবলেট। গ্রেফতারকৃতদের তথ্য মোতাবেক বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি ব্লকের ১১ নম্বর সড়ক থেকে আরও তিন বিদেশী নিওগুঙ্গা ডায়াসোনামা মার্লিন (৪১), মুতুমবো নাজিল ইউসূফ ও মিম্বা সার্গেজকে (৩৭)। এ তিন জনের কাছ থেকেও উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী জালনোট ও জালনোট তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজপত্রসহ নানা উপকরণ। র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মোঃ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, বিদেশীরা আফ্রিকার ক্যামেরুন ও কঙ্গোর নাগরিক। গ্রেফতারকৃত বিদেশীদের মধ্যে সাতজন ক্যামেরুনের এবং দুইজন কঙ্গোর নাগরিক। তাদের কারও ভিসার মেয়াদ নেই। গ্রেফতারকৃতদের কাছে অবৈধ মোবাইল ফোনের সিমকার্ডও পাওয়া গেছে। তারা আন্তর্জাতিক জালনোট তৈরি ও বাজারজাতকরণ চক্রের সদস্য। র‌্যাব কর্মকর্তা আরও জানান, চক্রটি প্রথমে মেইলে বাংলাদেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডলার বেচাকেনার প্রস্তাব দিত। তারা বাজারে প্রচলিত রংয়ের ডলারের পরিবর্তে কালো রংয়ের ডলার বিক্রি করত। আর এ কালো রংয়ের ডলার বিক্রিতে প্রতারণার আশ্রয় নিত চক্রটি। গ্রেফতারকৃতরা কিছু আসল ডলারের ওপর বিশেষ কালো রং করে রাখত। যখন কোন আগ্রহী তাদের সঙ্গে ব্যবসা করার আগ্রহ প্রকাশ করত, তখন তারা কালো ডলার বিশেষ কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করে দেখাত। প্রকৃতপক্ষে ডলারগুলো আসলই। এতে করে যারা প্রলুব্ধ হতো, তাদের কাছে কালো রংয়ের জাল ডলার বিক্রি করত। ক্রেতাদের ধারণা ছিল, কালো রঙ পরিষ্কার করলেই আসল ডলার বেরিয়ে আসবে। এমন প্রতারণার কবলে ফেলে বহু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু জাল ডলার নয়, প্রতারক চক্রটি জালটাকা তৈরি করেও বাজারে ছেড়েছে। তাদের তৈরি জালনোট এতটাই সূক্ষ্ম যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ধরা কঠিন। র‌্যাব কর্মকর্তা বলছেন, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জালনোট তৈরির ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারকৃতদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন, এমন অনেক ব্যক্তিরও সন্ধান মিলেছে। উদ্ধারকৃত ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা ও প্রতারিত হওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দী থেকে জানা গেছে, প্রথমত তারা কিছু আসল ডলার, কিংবা টাকা একটি বিশেষ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে সেটিকে কালো কাগজে পরিণত করে। পরবর্তীতে তারা সেই কালো কাগজগুলোকে ক্রেতাদের সামনে পুনরায় একটি বিশেষ কেমিক্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে আসল টাকায় পরিণত করে। পাশাপাশি উক্ত প্রতারক চক্রটি বিশেষভাবে তৈরি বিপুল পরিমাণ টাকা আকৃতির কালো কাগজ মজুদ রাখে। প্রতারক চক্রটির কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ টাকা আকৃতির কালো কাগজকে ডলার বানিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এজন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল, সরঞ্জাম ও পারিশ্রমিক বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। যারা রাজি হয়, তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। যা একেবারেই ভুয়া। চুক্তির ভিত্তিতে চক্রটি ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আগাম নেয়। টাকা নেয়ার পরেই তারা আত্মগোপনে চলে যেত। চক্রটি জালনোট তৈরি, বাজারজাতকরণের পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত। গ্রেফতারকৃতরা আন্তর্জাতিক জালনোট তৈরি বাজারজাতকরণ ও পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। তাদের বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে সক্রিয় এজেন্ট রয়েছে। চক্রটি চোরাকারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সহায়তায় জালনোট বিনিময় ও পাচার করত। গ্রেফতারকৃতদের হাতে অন্তত ৬০ থেকে ৬৫ জন অসাধু ব্যবসায়ী প্রতারিত হয়েছে। তাদের কারও কাছেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের মার্চ থেকে গ্রেফতারকৃত বিদেশীরা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, তারও আগ থেকেই তারা বাংলাদেশে অবস্থান করে থাকতে পারেন। ইতোপূর্বে তারা আরও কোন দেশে অবস্থান করে, এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিনা তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা যায়নি। তবে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ধারণা করা হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক জালনোট তৈরি ও বাজারজাতকরণ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় মাদক, পাসপোর্ট, প্রতারণসহ বিভিন্ন আইনে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত নয় বিদেশী যে দুইটি দেশের নাগরিক, সেই দুইটি দেশের কোন দূতাবাস বাংলাদেশে নেই, এজন্য গ্রেফতারকৃত বিদেশীদের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দেশ দুইটির সঙ্গে কোন যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। মামলা দায়েরের পর পুলিশের তরফ থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে যোগাযোগ হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্র বলছে, গত শনিবার রাজধানী থেকে ৪৪ জন অবৈধ নেপালী নাগরিককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তবে গ্রেফতারকৃত নেপালীদের কাছ থেকে অপরাধ সংঘটনের কোন আলামত উদ্ধার হয়েছিল না। তারপরও গ্রেফতারকৃত নেপালীদের সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে নেপালীদের নিজ নিজ দেশে কোন অপরাধ সংঘটনের তথ্য মেলেনি। এয়াড়া কোন অসৎ উদ্দেশ্যেও তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল না বলে তথ্য পাওয়া যায়। এজন্য তাদের নেপালে পুশব্যাক করা হয়। কিন্তু রবিবার গ্রেফতার হওয়া নয় বিদেশীর কাছ থেকে অপরাধ সংঘটনের প্রচুর আলামত উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া তাদের কাছে অনেকেই প্রতারিত হয়েছেন। এজন্য দেশের প্রচলিত আইনেই গ্রেফতারকৃতদের বিচারের মুখোমুখি করতে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
×