ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৯ আগস্ট ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

শ্রাবণ শেষ প্রান্তে চলে এলো; বিগত সাত দিন ঢাকার প্রায় খটখটে অবস্থা দেখে মনেই হলো না বর্ষাকাল চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বরং বর্ষাকে বিদায় জানাতেই যেন ঢাকা ব্যতিব্যস্ত। কবিগুরুর প্রয়াণদিবস বাইশে শ্রাবণে ঢাকায় বৃষ্টি হবে নাÑ এটা ভাবতেই পারেন না ঢাকাবাসী রবীন্দ্রপ্রেমী। তার খুব একটা নজীরও অবশ্য নেই। এবারই মনে হলো ব্যতিক্রম। বাইশে শ্রাবণে বৃষ্টির দেখা মিলল না। অবশ্য একথা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে দাবি করাতেও মন উশখুশ করছে। সত্যি বলতে কী ঢাকা এখন এতটাই সম্প্রসারিত হয়ে গেছে যে তার কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাত হলে অন্যত্র বৃষ্টিহীন রুখাসুখা থেকে যেতেই পারে। গত সপ্তাহে মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের বৃষ্টির কথা বলেছিলাম। সেটি ঢাকার মধ্যাঞ্চলের। মানে ধানম-ি-ফার্মগেট-শাহবাগ এলাকায়। তাতেই লবেজান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল রাজাবাজার এলাকায়। বাইশে শ্রাবণের আগের সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে ঘাবড়ে গেলাম। পশ্চিম ও উত্তর আকাশে ঘন কালো মেঘ। ধারণা হলো জবর বর্ষা নামবে। কী অবাক ব্যাপার, বৃষ্টি হলোই না। যা হোক শুরুতে চটজলদি দেখে নেয়া যাক কতিপয় বিষয় যেগুলোকে বলতে পারি গত সপ্তাহের রাজধানীর নির্বাচিত অবয়ব। ক্স ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নতুন নির্দেশ এলো পুরান ঢাকার কেমিক্যাল কারখানা সরানোর। প্রায় অর্ধযুগ আগে নিমতলির ট্র্যাজেডির কথা ঢাকাবাসীর স্মরণে আছে। এত বছরেও ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম অপসারণে অগ্রগতি না আসা দুঃখজনক। এবার যদি হয়। ক্স কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণদিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হলো রাজধানীতে। শুধু যে কবির গান কিংবা সংগীতনির্ভর আয়োজন ছিল এদিন, তা নয়। ছিল বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ। ক্স দলবদলে পারদর্শিতার জন্য অনেকেই ভদ্রলোককে মিস্টার ডিগবাজি নামে সম্বোধন করে থাকেন। তিনি বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক মন্ত্রী, বর্তমানে বিএনপি নেতা। আপিলের রায়ে হেরে গুলশানে তার দেড় বিঘা জমির ওপর বানানো বাড়িটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। ক্স সাময়িকভাবে বন্ধ থাকা ব্রিটিশ কাউন্সিল খুব শিগগিরই খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক। তিনি জানান ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবনের বেশকিছু অবকাঠামোগত সংস্কারের কাজ বাকি ছিল। সেগুলো শেষ হওয়া মাত্রই সেটি সবার জন্য আবার উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। গুলশানে হামলার পর পুলিশী নিরাপত্তা নিয়ে হাইকমিশন খুশি বলেও তিনি জানান। ফলোআপ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ঈদের পর কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রাজধানীর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল না খোলার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম গত লেখায়। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল বলে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে নিরাপত্তাজনিত চিঠি ইস্যু করা হয়। তাতে কিছু অনুরোধ জানানো হয় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে। যার ভেতরে ছিলÑ প্রতিষ্ঠান/স্থাপনাসমূহের ভিতর, ভিতরের রাস্তা, বাইরের রাস্তা ও বিভিন্ন কৌশলগত এলাকাকে সন্নিবেশিত করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ও উন্নতমানের সিসি ক্যামেরা (রাত্রিকালীন ছবি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন) স্থাায়ীভাবে স্থাপন/সংযোজন করা। প্রতিষ্ঠান/স্থাপনাসমূহের প্রবেশ পথে হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে দেহ তল্লাশির ব্যবস্থার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে আর্চওয়ে গেট স্থাপনা করা ইত্যাদি। একেকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের যে বড় অঙ্কের উপার্জন তাতে এ জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা মোটেই সমস্যার নয়। সময়সাপেক্ষ তো নয়ই। তবু রাজধানীর কোন কোন স্কুল এটিকে ইস্যু করে অভিভাবকদের বরাবরে এসএমএস করে জানায় যে যতদিন পর্যন্ত স্কুলের নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা না যাবে ততদিন স্কুল বন্ধ থাকবে। বলাবাহুল্য কোন কোন স্কুল জুলাইয়েই অগ্রিম ভিত্তিতে আদায় করে নেয় আগস্টের বেতন। স্কুল খোলার নাম নেই অথচ অগ্রিম বেতন আদায়! বিষয়টি অনুধাবন করতে সমর্থ হয় শেষ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাই পুনরায় ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ঘোষণা দেয়া হয় আজ (মঙ্গলবার) থেকে স্কুল চালু হবে। তবে বইয়ের বদলে শুধু একখানা খাতা স্কুলব্যাগে নেবার কথা ক্ষুদে বার্তায় বলা হয়েছে। সুপার শপের কা-! অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রির দায়ে মোহাম্মদপুরে ‘মীনা বাজার’ সুপার শপকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বলাবাহুল্য ওই প্রতিষ্ঠানটিকে এই প্রথম জরিমানা করা হলো, এমন নয়; বলা চলে প্রতিবছরই কয়েক দফা তিন চারটি নামী-দামী সুপার শপের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অনিয়ম-অপরাধের জন্য জরিমানা করা হয়ে থাকে। এটি সম্ভবত তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। বছরভর তারা যে বিরাট অঙ্কের মুনাফা অর্জন করে সেখান থেকে দু-পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনলে এমন কী এসে যায়Ñ এমনটাই ভাবে তারা। সুনাম-দুর্নামের ব্যাপারটি বোধহয় ধর্তব্যেই আনে না। অথচ ঢাকার লাখ লাখ পরিবার এদের বিক্রীত পণ্যের ওপরেই নির্ভর করে থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নতুন করে ভাবতে অনুরোধ করব। শুধু অর্থদ- দিয়ে সুপার শপগুলোর বেপরোয়া বিকিকিনি বন্ধ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। ‘নগর’ এ্যাপে নাগরিক সেবা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আনুষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল মোবাইল অ্যাপ ‘নগর’ চালু করেছে। এ্যাপটির মাধ্যমে এলাকার রাস্তা, সড়কবাতি, বর্জ্য, ড্রেনেজ, মশা, অবৈধ দখল, ঘুষ ও দুর্নীতিÑ এই সাতটি অভিযোগ বা মতামত সরাসরি সিটি করপোরেশনে পাঠানো যাবে। মোবাইলে ছবি তোলার পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে যাবে। সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন জোনে থাকা বড় পর্দায় প্রতিটি অভিযোগ ও মতামত দেখা যাবে। অভিযোগের প্রকার বিশ্লেষণ করে সিটি করপোরেশন যে সমাধানের উদ্যোগ নেবে, সেটিও জানা যাবে। সমস্যার সমাধান হলে অভিযোগকারী স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিষয়টি জেনে যাবেন। এই না হলে ডিজিটাল যুগ। বঙ্গবন্ধুর জীবনীমূলক ইংরেজী বই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আত্মজীবনী, কবিতা, গল্পগ্রন্থ রচিত হলেও ইংরেজী ভাষায় তা অপ্রতুল। পৃথিবীর রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নামটি বারবার উচ্চারিত হলেও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, অন্তত যারা ইংরেজী ভাষার চর্চা বা কথা বলেন, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু পাঠ কিছুটা দুরূহই বটে। সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক সৈয়দ বদরুল আহসান নতুন উদ্যোগ নিলেন। তরুণ বয়সে কাছ থেকে দেখা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবনের নানা চালচিত্র নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ বইটি। দিল্লীর নিয়োগি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। বাংলাদেশে এই বইটির পরিবেশক পাঠক সমাবেশ। প্রসঙ্গত সজ্জন সুরসিক সৈয়দ বদরুল আহসান ইংরেজি সংবাদপত্রের জন্য দুই হাতে বহুধর্মী লেখায় পারদর্শী। দারুন বাগ্মীও বটে তিনি। প্রাণোচ্ছল আড্ডাবাজ এই মানুষটি হারানো দিনের গান ও কৌতুক শুনিয়ে বন্ধুদের আনন্দ দিতে পছন্দ করেন। শনিবার পাঠক সমাবেশে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই মন্ত্রীসহ গুণীজনেরা তাঁর বইটির অকৃপণ প্রশংসা করেন। সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গল্প, কবিতা তো আর নিহায়ত কম লেখা হয়নি। তবে রাজনৈতিক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বলতে আমি বদরুল আহসানের বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করব। লেখক অল্প পরিসরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। ২৮০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীমূলক বইটির দাম রাখা হয়েছে ১ হাজার ১৯০ টাকা। উল্লেখ্য, পুরো আগস্ট জুড়েই বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের প্রদর্শনীর পাশাপাশি নতুন নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে পাঠক সমাবেশ। নির্বাচিত ফেসবুক পোস্ট শোকের মাস আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ চলছে বিশেষভাবে। সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে নানা আয়োজন শুরু হয়েছে আগস্টের প্রথম দিনটি থেকেই। আজ নির্বাচিত ফেসবুক পোস্ট হিসেবে তুলে দিচ্ছি সাবেক ছাত্রনেতা কবি মিনার মনসুরের পোস্ট। তিনি লিখেছেন : ‘আমরা প্রতিবাদের পথ খুঁজছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম যে গোপন লিফলেট ও কাঙালিভোজের মতো নির্বিষ কর্মসূচীতে কাজ হবে না। এমন কিছু করা দরকার যাতে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকদের ঘুম হারাম করে দেয়া যায়। ঘা মেরে জাগিয়ে দেয়া যায় জাতির অবরুদ্ধ বিবেক। ঠিক এ সময়েই গোটা দেশ কাঁপিয়ে দেয় নির্মলেন্দু গুণের অসাধারণ একটি কবিতা। কবিতাটির নাম ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। যতদূর মনে আছে, কবিতাটি তিনি প্রথম পাঠ করেছিলেন বাংলা একাডেমি চত্বরের একটি অনুষ্ঠানে। হৈ চৈ পড়ে যায়। পুলিশ আসে। কবিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। গুণদার কাছে পরে শুনেছি আলামত নষ্ট করার জন্য হাতে লেখা কবিতাটি তিনি চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। তাতে কী! বিদ্যুত গতিতে কবিতাটি ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। আসন করে নেয় মানুষের চেতনায়। আমরাও কবিতাটি মুদ্রিত করে বিতরণ করেছি। আমরা প্রতিবাদের সর্বোত্তম পথটির সন্ধান পেয়ে যাই। ১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট (বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় শাহাদাৎ বার্ষিকী) আমরা প্রকাশ করি ‘এপিটাফ’। সেটা ছিল কাঠের ব্লক আর সিসার টাইপের যুগ। নিউজপ্রিন্টে মুদ্রিত ডিমাই ১/৮ সাইজের এ ছোটকাগজটির প্রচ্ছদজুড়ে স্থান পায় বঙ্গবন্ধুর শাদাকালো একটি ছবি। ছবির ওপর লালকালিতে ছাপা হয় বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় কিছু উক্তি। আর ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু গদ্য ও পদ্য। এখন অনেকের কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে ঢাকা-চট্টগ্রামের বেশিরভাগ লেখকই সেদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লিখতে রাজি হননি। এমনকি বেনামেও নয়। অনন্যোপায় হয়ে আমরা কিছু কবিতা ও গদ্য পুনর্মুদ্রণ করি। তার মধ্যে ছিল তারাপদ রায়ের চমৎকার একটি কবিতাও। এটি ছিল এপিটাফ-এর প্রথম সংখ্যা। এমন কিছু নয়। লেখক তালিকা খুবই সাদামাটা। ছাপার মানও ভালো নয়। তবু সাড়া পড়ে গিয়েছিল। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ফুরিয়ে গিয়েছিল সব কপি। পরে আমরা এ ছোটকাগজটির প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছিলাম ১৯৯১ সাল অবধি। অনেকেই আজও জানতে চান, এত অল্প বয়সে আমরা ‘এপিটাফ’ নামটির প্রতি কেন আকৃষ্ট হয়েছিলাম? কারণ একটাই, পঁচাত্তরের পৈশাচিকতার প্রতিবাদ। অর্বাচীণ ঘাতকেরা সেদিন বাঙালীর শ্রেষ্ঠসন্তানটির প্রতি যে চরম অমর্যাদা ও ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল এবং জাতির ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার যে অসম্ভব দম্ভ প্রকাশ করেছিল— বঙ্গবন্ধুর ‘এপিটাফ’ রচনার মাধ্যমে আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দিতে চেয়েছিলাম। শোককে পরিণত করতে চেয়েছিলাম শক্তিতে।’ ৭ আগস্ট ২০১৬ সধৎঁভৎধরযধহ৭১@মসধরষ.পড়স
×