ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব আদিবাসী দিবস ॥ আদিবাসীদের অধিকার যেন খর্ব না হয়

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৯ আগস্ট ২০১৬

বিশ্ব আদিবাসী দিবস ॥ আদিবাসীদের অধিকার  যেন খর্ব না হয়

আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশেও প্রায় ৩০ লাখের বেশি জনসংখ্যার ৪৫টিরও বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো : আদিবাসীদের ভূমি ও জীবনের অধিকার। মহামতি লেনিন বলেছেন, ‘মানুষ তার পিতৃশোক ভুলতে পারে কিন্তু ভূমি হারানোর শোক কখনই ভুলতে পারে না।’ অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির এক আদিবাসী নেতা বলেছেন, ‘ভূমিই আদিবাসীদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। ভূমি আমাদের ঠিকানা, অস্তিত্ব। ভূমি আছে বলেই জীবন এত গতিময়। ভূমি জীবনের প্রতীক। এ ভূমি আমাদের, আমরাও ভূমির। ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নিই। আমরা ভূমি থেকে আসি, আবার ভূমিতেই ফিরে যাই।’ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য প্রত্যেকের ভূমির অধিকার রয়েছে। আদিবাসীদের সেই অধিকার মাঝে মাঝে ক্ষুণœ হচ্ছে। তাদের জোর করে বাস্তুচ্যুত করা নতুন নয়। ঘরবাড়ি, জমিজমা থেকে উচ্ছেদ করছে। সিলেটের কয়েকটি পুঞ্জি থেকে খাসিয়াদের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। মধুপুর ও সিলেটের কয়েকটি আদিবাসী এলাকায় ইকো পার্ক নির্মাণের নামে আদিবাসীদের গৃহবন্দী ও উচ্ছেদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে সিলেটের মাধবকু- ও লাউয়াছড়া পুঞ্জিতে ইকো পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে খাসিয়াদের নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আর মানুষের বেশি আনাগোনায় পানে রোগবালাই দেখা দিচ্ছে। তাদের ক্ষয়ক্ষতি ও লোকসান হচ্ছে। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের আদিবাসীরা কাপ্তাই বাঁধের কারণে নিজস্ব জায়গাজমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। তাদের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো, হাজং ও অন্য আদিবাসীরা ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তাদের ভিটেমাটি, জমিজমা ফেলে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আবার ১৯৬৪ সালে আরেক দফা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে গারো, হাজং ও অন্য আদিবাসীরা ভারতে চলে গিয়েছিল। আর তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্রের নিকট অর্পিত হয়ে যায়। পরে ১৯৭৪ সালে সরকার ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন ১৯৭৪’ প্রণয়ন করে। তারপর থেকে এই আইনটি লাগামহীনভাবে অন্যদের মধ্যে বিশেষ করে রাজশাহী, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপব্যবহার করা হয়। এই সুযোগে তাদের জমিজমা অন্যরা দখল করে নিয়েছে। এমনি করে অনেক আদিবাসীই তাদের ভূমি, জমি, ভিটে বাড়ি হারাতে হয়েছে। ভারত থেকে ফিরে এসে অনেকেই তাদের জমি আর ফিরে পায়নি। তবে আশার কথা বর্তমান সরকার এই আইনের সংশোধন করছে। এই আইন সংশোধন করে অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় অন্যায়ভাবে অথবা ভিত্তিহীনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভূমিগুলো তালিকা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে এবং প্রকৃত মালিকদের কাছে মালিকানা ও দখল ফিরিয়ে দিচ্ছে। ধনী ও সবলদের লোলুপ দৃষ্টি থাকে দুর্বল, সংখ্যালঘু, আদিবাসীদের ভূমির দিকে। সুযোগ পেলেই দখল করে নেয় তারা। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি স্মরণ করা যায়। জমিদার জোর করেই দরিদ্র উপেনের দুই বিঘা জমি দখল করে নিয়েছিল। এমনি করে আজও জোর করে দুর্বলের জমি দখল করার প্রবণতা দেখা যায়। এখনও আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এরকম লোকের অভাব নেইÑ যারা অন্যের জমি দখল করে থাকে। বিশেষ করে আদিবাসীদের জমি দখল করতে তারা সদা তৎপর। গারো জাতির ভূমির দিকে তাদের দৃষ্টি বেশি থাকে। কারণ গারো জাতি মাতৃতান্ত্রিক জাতি। গারো মেয়েরাই ভূমি ও জমির মালিক হন। তাই ছলেবলে কৌশলে তাদের বিয়ে করে জমি দখলের চেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে জমি দখল করে নিচ্ছে। এই জোরজুলুম ও দখলদারিত্ব রোধে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার হস্তান্তরের জন্য ওই সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রচলিত পদ্ধতিকে সম্মান করতে হবে এবং তাদের যে প্রথা ও ঐতিহ্যগত আইন রয়েছে তা পালন করতে হবে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের ৪৬টি অনুচ্ছেদের ১৩-১৯ অনুচ্ছেদের মধ্যে ভূমির অধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ‘সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখলে থাকা ভূমির ওপর মালিকানা ও ভোগদখলের অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। অধিকন্তু তাদের সম্পূর্ণভাবে দখলীকৃত নয়, কিন্তু তাদের জীবনধারণ ও ঐতিহ্যগত কার্যক্রমের জন্য প্রথাগতভাবে প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন ভূমি ব্যবহারের অধিকার সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যাযাবর জনগোষ্ঠী ও জুম চাষীদের অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর প্রদান করতে হবে।’ সেখানে আরও বলা হয়েছে- আদিবাসীদের জোর করে তাদের এলাকা বা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। যেসব ভূমি, এলাকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল বা ব্যবহার করে আসছে তার ওপর আদিবাসীদের অধিকার রয়েছে। ভূমি সমস্যা নিরসনের জন্য জাতীয় আইনী ব্যবস্থার মধ্যে পর্যাপ্ত কার্যপ্রণালী গড়ে তুলতে হবে। সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভূমি অবৈধ দখল ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনে পর্যাপ্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সরকার এ ধরনের অপরাধ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রে আদিবাসীদের জীবনের অধিকার রয়েছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মতো রাষ্ট্রে তাদেরও বসবাস ও জীবনযাপন করার অধিকার রয়েছে। স্বাধীনভাবে ধর্মপালন, শিক্ষা অর্জন, ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি অনুশীলনের অধিকার রয়েছে। তাদের জীবন রক্ষা করার দায়িত্বও রাষ্ট্রের রয়েছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ নম্বর ২০-এ বলা হয়েছে : ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ও উন্নয়নের নিজস্ব ধারা নিশ্চিত করার জন্য এবং তাদের ঐতিহ্যগত ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্বাধীনভাবে নিযুক্ত থাকার জন্য নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান বজায় রাখা ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।’ সেই ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ২২-এ আরও বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র আদিবাসী নারী ও শিশুরা যাতে সকল প্রকার সহিংসতা ও বৈষম্য থেকে রক্ষা পায় এবং তা নিশ্চিয়তার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করে তা নিশ্চিত করার জন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ তাই রাষ্ট্র ও সরকারের নিকট আমাদের প্রত্যাশা, দেশের নাগরিক হিসেবে যে অধিকারগুলো পাবার কথা তা রাষ্ট্র ও সরকার যেন নিশ্চিত করে। আদিবাসীদের উচ্ছেদ, ভূমি দখল ও তাদের অধিকার খর্ব করে কোন স্থাপনা তৈরির পদক্ষেপ যেন বন্ধ করা হয়। মড়ঁৎড়নপংপ@মসধরষ.পড়স
×