ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রফেসর আজিজুর রহমান

পারিবারিক সততাই সন্তানকে মহৎ করে

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৮ আগস্ট ২০১৬

পারিবারিক সততাই সন্তানকে মহৎ করে

বর্তমান অসহিষ্ণু বিশ্বে বহু অভিভাবক বিত্তশালী হয়েও নিজ সন্তানকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারছেন না। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষাই এর মূল কারণ। এর সুযোগে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি, ধর্মের অপব্যবহার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বর্তমান প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজ বাবা-মা বা অভিভাবকরা সচেতন হয়ে সমাজের নৈতিক দিকগুলো সন্তানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে প্রজন্মকে বাস্তবমুখী করে তাদের কল্যাণ আনয়ন সম্ভব। সম্পদের প্রাচুর্য বা দরিদ্রতা মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু বাদসাধে না। নীতি বিজ্ঞানে একটা কথা আছে, ‘মরিয়া বাঁচ’ (উরব ঃড় খরাব)। কল্যাণকর কাজের মাধ্যমে মানুষ মরেও যেমন জীবিত থাকে এমন অনেক নজির এ দেশে বা পৃথিবীতে আছে। বিশেষ করে মা-বাবা বা অভিভাবকের আচার-আচরণ সন্তানের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত নৈতিক উপকরণাদি বা ধর্মীয় নীতিবোধ সন্তানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় এ বোধটুকু জাগ্রত করাই পরিবারের কাজ। আমার ব্যক্তি জীবনে দুটি পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থেকে মা-বাবার দিক নির্দেশনাই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষা অধিদফতরে আমার কর্মকালীন অবস্থায় মহাপরিচালক হিসেবে প্রফেসর নাইয়ার সুলতানার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাই। তারই স্বামী ছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। রফিকুল্লাহ চৌধুরী ষাটের দশকে তৎকালীন নেত্রকোনা মহকুমায় ঝ.উ.ঙ (সাবডিভিশনাল অফিসার) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঝ.উ.ঙ হিসেবে তার কর্মতৎপরতায় নেত্রকোনায় অনেক উন্নতি হয় এবং তার সততা সম্পর্কে এখনও অনেক প্রবীণ লোক উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তারই সহধর্মিণী প্রফেসর নাইয়ার সুলতানার কর্মক্রমও প্রশংসার দাবিদার। উভয়ের সহজ সরল জীবনযাপনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মসম্পাদন, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধকরণ, জাতীয়তাবোধে জাগ্রত থাকা, দেশপ্রেমে অংশীদার হওয়ার মতো গুণগুলো তাদের সন্তানের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। রফিকুল্লাহ চৌধুরী পাকিস্তান আমলে বাঙালী সিএসপি অফিসার ছিলেন। দেশপ্রেমের কারণেই চাকরিচ্যুত হন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী এবং প্রয়াত প্রফেসর নাইয়ার সুলতানারই সুযোগ্য কন্যা ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আজ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার হিসেবে আসীন। মা-বাবার সততায় বলীয়ান হয়ে দেশসেবায় মগ্ন। আজ তাঁর মা-বাবা জীবিত থাকলে সত্যি উপলব্ধি করতেন তাদের পারিবারিক সেই শিক্ষা কন্যার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পরিবারের ঐতিহ্য কন্যা ধারণ করে আছে। মা-বাবা যেমন মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন, কন্যার ক্ষেত্রেও তা বিরাজমান। আর একটি পরিবারের উন্নয়ন সততার গুণেই এবং পরিবারের কর্ণধার প্রথম চিকিৎসক এবং পরবর্তীকালে রাজনীতিক হিসেবে সুপরিচিত। রাজনীতি করেও যে সন্তানদের সুশিক্ষিত ও কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা যায় তার প্রমাণ এই রাজনীতিক। তিনি হলেন ডাঃ আখলাকুল হোসেন আহমদ বর্তমান নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় ছয়াশি গ্রামে তাঁর আবাস ভূমি। তিনি ডাঃ হিসেবে আটপাড়া উপজেলায় কর্মরত থাকায় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তাঁর সান্নিধ্যে আসি। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ হই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মোহনগঞ্জ-বারহাট্টা ময়মনসিংহ-২২ আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে মুক্তাঞ্চল করে একটি এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন করে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি যেমন সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তেমনি কর্তব্যবোধে ও ন্যায়নিষ্ঠার প্রতি ছিলেন অবিচল। কর্মে প্রেরণা দান তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। ধর্ম এবং কর্মের মাধ্যমে যে আদর্শ সৃষ্টি হয় তারই প্রতিফলন ঘটেছে তার সন্তানদের ক্ষেত্রেও। তার দুই সন্তানের একজন ওবায়দুল হাসান বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে কর্মরত। অন্যজন সাজ্জাদুল হাসান (অতি-সচিব) বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ পদে আসীন। দুইজনই তাদের পারিবারিক গুণে-গুণান্বিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নেত্রকোনা জেলায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতে চলছে। শেখ হাসিনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলে এ অঞ্চলে মানুষ উচ্চশিক্ষার সুবর্ণ সুযোগ পাবে। এ ব্যাপারে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ধ্যান-ধারণা উন্নয়নমূলক। তাঁর ভেতর কর্তব্যবোধ সদাজাগ্রত। নেত্রকোনার সন্তান হিসেবে তাদের আন্তরিকতার অভাব নেই এটাই ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। আমি দুটি পরিবারের কথা এখানে তুলে ধরেছি এই কারণে যে, পরিবারই হচ্ছে সুসন্তান গড়ে তোলার উপযুক্ত স্থান। সুসন্তানরাই একদিন সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। এই দুটি পরিবার বর্তমান সময়ের ধনী পরিবারগুলোর মতো শুধু অর্থবিত্তে সচ্ছল ছিলেন না, তারা শিক্ষা দীক্ষায় এবং সততা ও নৈতিকতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেই ছায়া তাদের সন্তানদের উপর পড়েছে। আজকাল সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তানরা বেপথু হচ্ছে, জঙ্গী-সন্ত্রাসী হচ্ছে। আর ভয়ের কারণ হচ্ছে সেখানেই। এই পথ থেকে আমাদের ফিরতে হবে। আমাদের সন্তানদের ফিরাতে হবে। এর জন্য দরকার পরিবারে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা। আমরা প্রতিটি পরিবার নিজেদের সন্তানদের সেই শিক্ষা দিতে পারি। পারিবারিক সততাই সন্তানকে মহৎ করে এই সত্যটি আমাদের অনুধাবন করতে হবে। লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কবি নজরুল সরকারী কলেজ, ঢাকা
×